দুর্নীতি দমন করার দায়িত্ব যে সংস্থার, সেই দুর্নীতি দমন কমিশনেরই (দুদক) কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িয়ে পড়ছেন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে। এ ধরনের ঘটনায় অতীতে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও নতুন করে কারও না কারও নাম অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যে দুদক সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা করে থাকে, এবার নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িত সন্দেহ কর্মীদের তালিকা করতে যাচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা সামনে আসায় এ পথে হাঁটছে সংস্থাটি।
ইতোমধ্যে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, অনৈতিক কাজে দুদকের কেউ জড়িত কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কেউ দুদকে থাকতে পারবে না। এ জন্য গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অন্যান্য সংস্থাকেও বলা হবে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে, তাদের ব্যাপারে কমিশন থেকে কোনো ধরনের শিথিলতা দেখানো হবে না। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ নেন বলে কথিত আছে, তাদের একটি তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই তালিকায় যারা থাকবেন তাদের কড়া নজরদারিতে রাখা হবে। দুদক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কাছে অভিযোগ আসামাত্রই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গত ২৩ জুন মতিঝিলের একটি হোটেলে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষগ্রহণের সময় দুদকের এক মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী গৌতম ভট্টাচার্য্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এর পরদিন আদালতের মাধ্যমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে পাঠান ঢাকা মহানগর হাকিম হুমায়ুন কবীর।
গোয়েন্দা পুলিশের অভিযোগ, এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ দাবির পর গৌতমকে ফাঁদ পেতে গ্রেপ্তার করা হয়। দুদক কর্মকর্তাদের সই জাল করে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের একটি ভুয়া চিঠি তৈরি করে তা নথিভুক্ত না করার আশ্বাস দিয়ে ২ কোটি টাকা দাবি করেন গৌতম। ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় ‘অন্যের রূপ ধারণ’ করে প্রতারণা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে।
এর আগে ১১ জুন চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার বনৌজা নামের একটি রেস্টুরেন্টে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় দুদকের গাড়িচালক মো. সফিউল্যাহ ও কনস্টেবল এমরানকে আটক করে পুলিশ। যদিও দুদকের পক্ষে চট্টগ্রামের ইপিজেড থানা থেকে ওই দুই কর্মচারীকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক ব্যবসায়ীর নামে নিজেরাই দুদকে অভিযোগ জমা দিয়ে সেই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত টাকা আদায় করতেন দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কনস্টেবল এমরান হোসেন ও তার সহযোগীরা। ওইদিন বনৌজা রেস্টুরেন্টে টাকা আনতে গেলে পুলিশের হাতে আটক হন সফিউল্যাহ ও এমরান। এরপর ওই ঘটনায় তাদের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বদলি করে দুদক।
অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগে মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী গৌতম ভট্টচার্য্য, গাড়িচালক সফিউল্যাহ ও কনস্টেবল এমরান হোসেনকে গত রবিবার সাময়িক বরখাস্ত করেছে দুদক। গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের
মধ্যে কোনা দুর্নীতিবাজ বা অন্যায় কাজ করে এমন ব্যক্তি থাকতে পারবে না। একজন কর্মচারীকে পুলিশ গ্রেপ্তারের পর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। যারা হাতেনাতে ধরেছে, তাদের বলেছি যে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক। একই সঙ্গে বলেছি, আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তদন্তে বেরিয়ে আসুক। সেই কর্মচারীকে আমরা সাময়িক বরখাস্ত করেছি। পুলিশ থেকে মামলা হয়েছে, আমরাও বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থার করব।’ চেয়ারম্যান আরও জানান, এমন আরও যারা আছে, তাদের শনাক্ত করতে আমরা চেষ্টা করছি।’
এর আগে গত এপ্রিলে দুর্নীতি মামলার ভয় দেখিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষগ্রহণের অভিযোগ ওঠে দুদকের বগুড়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে উপসহকারী পরিচালক সুদীপ কুমার চৌধুরীর বিরুদ্ধে। গত ৯ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বোন রুমাইয়া শিরিন দাবি করেন, তার ভাই আলমগীর হোসেন বগুড়া জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আলমগীরের বিরুদ্ধে এক নোটিশের মাধ্যমে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে বলা হয়। এরপর তিনি সম্পদের বিবরণী দাখিল করেন।
সম্পদ বিবরণী যাচাইয়ের দায়িত্ব পান ডিএডি সুদীপ কুমার চৌধুরী। পরে তিনি মামলার ভয় দেখিয়ে সাত লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। ভয়ে আলমগীর পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করলেও এতে সন্তুষ্ট না হয়ে মামলা করেন দুদক কর্মকর্তা। সুদীপ কুমার চৌধুরী নিজে বাদী হয়ে মামলা করার পর নিজেই সেই তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে আবার আগের টাকা দাবি করেন। ওই ঘুষ দাবির অডিও রেকর্ডসহ সুদীপ কুমার চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদকের চেয়ারম্যান বরাবর একটি অভিযোগ দেওয়া হলে তাকে বগুড়া থেকে রাজশাহীতে বদলি করা হয়।
এ ছাড়া সম্প্রতি দুদকের সমন্বিত পাবনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ সংক্রান্ত একটি ভিডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এক ব্যবসায়ীসহ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর। অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আশ্বাস দিয়ে হক টেক্সটাইলসের মালিক ওই ব্যবসায়ী শামসুল হকের কাছে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন তিনি। কয়েক দফায় ৭৬ হাজার টাকা গ্রহণ করেন এ কর্মকর্তা। এ ঘটনার পর মোস্তাফিজুর রহমানকে পাবনা থেকে দুদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কোনো কাজকে প্রশ্রয় দেব না। এমন আরও কে কে আছে তাদের বের করতে আমরা চেষ্টায় আছি। আমাদের এই অফিসের ভেতরে এমন আরও কেউ আছে কিনা এবং পুলিশকেও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে আর কে কে আছে তা উদ্ঘাটন করার জন্য বলেছি।’
দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাঁদাবাজি ও ঘুষগ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা ঘুষগ্রহণের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগে ব্যুরোর আমলেও এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দেখা যায়। এসব ঘটনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থেকেছে। তিনি বলেন, কেউ যদি চাঁদাবাজি ও ঘুষগ্রহণের ঘটনায় চিহ্নিত হয়, তার বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণই নয়, তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দুদকের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আরও বেড়ে যাবে। শর্ষের মধ্যে ভূত আছে- সে প্রশ্নই উঠে আসবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুদক অন্য ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। এ জন্য চাঁদাবাজি ও ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মূল্যবোধের শিক্ষাও দিতে হবে। তাদের আইনি দায়িত্ব পালনের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মনে করিয়ে দিতে হবে।