নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় সংসারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব। হিসাব মেলাতে হচ্ছে ধারকর্জ করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি।
বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গ্রাম ও শহরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রায় সমান। গ্রামে এখন মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ, শহরে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
গত মে মাসে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালের মে মাসে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের মে মাসে একই পণ্য কিনতে তার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণত ধনী-গরিব সবার ওপর পড়ে। এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সাড়ে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই শুরু হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আগস্টে জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি এক লাফে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ উঠে যায়, যা ২০১১ সালের এপ্রিলের পর সর্বোচ্চ। এরপর টানা পাঁচ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি কমে। তবে তা
কোনো মাসেই সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। গত তিন মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ধারায় রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম কমছে। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আমদানিকারকরা এর জন্য মূলত ডলার সংকট এবং আমদানির এলসি খোলায় কড়াকড়িকে দায়ী করে থাকেন।
এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ আমলে নিয়ে নতুন অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ৫ শতাংশ প্রণোদনা কার্যকর করা হয়েছে। এতে করে সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে। এতে বেসরকারি চাকরিজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা জীবনযাত্রা নিয়ে আরও চাপে পড়তে পারেন বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষের পাশাপাশি কষ্টে আছে শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীও। টিকতে না পেরে ঢাকা ছাড়ছে অনেক মানুষ। বেড়েছে যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয়।
সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে, গত বছরের জুনে এক কেজি চিনির দাম ছিল সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা। আর চলতি বছরের ৩০ জুন সেই চিনি কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায়। সে হিসাবে চিনির দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। ৫০ টাকার নিচে বাজারে কোনো চাল পাওয়া যায় না। একইভাবে প্রতি দুই কেজি আটার (প্যাকেট) দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০ টাকা। সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। সম্প্রতি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে আদা, রসুন, পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের দাম। এক কেজি কাঁচামরিচের দাম ঠেকেছে ৬০০ টাকায়। আর প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা। রসুনের কেজি ৩০০ টাকার মতো। এ ছাড়া বাজারে ২০০ টাকার নিচে কোনো মাছ নেই। একইভাবে ব্রয়লারসহ সব ধরনের মুরগির দামও বেড়েছে।
এদিকে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন করবেন, সে বিষয়ে নির্দেশনা নেই। শুধু আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য কমার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে দ্রব্যমূল্য কমে আসবে বলে ধারণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অনেক সময়ই আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারে প্রভাব পড়ে না। ফলে অর্থমন্ত্রীর এই টুলস কাজে নাও আসতে পারে।
বিশ^ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বাজেটে বিশাল ঘাটতি ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিশাল রাজস্ব আহরণ করতে পরোক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে। এ দুটি কারণ মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। ফলে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি অর্জিত খুবই কঠিন।