পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন লাখো মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার ভোর হতেই সড়ক, রেল ও নৌপথে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেন তাদের অনেকে। বাড়ি ফিরতে কেউ কেউ আকাশপথও বেছে নেন। ঈদের দুই দিন আগে গতকাল সড়কপথে অনেক চাপ বেড়ে যায় গাড়ির। আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সড়ক-মহাসড়কে বড় ধরনের যানজট সৃষ্টি হয়নি। বিনা টিকিটে যাত্রী উঠতে না দেওয়ায় এবার রেলযাত্রায় স্বস্তির কথা জানিয়েছেন যাত্রীরা। পদ্মা সেতু হওয়ায় তেমন ভিড় নেই নৌপথেও। তবে গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় ঘরমুখো মানুষকে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি অভিযোগ করেছে, যাত্রা নির্বিঘ্ন হলেও সড়ক ও নৌপথের বিভিন্ন রুটে ভাড়া-নৈরাজ্য চলছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বাস ও লঞ্চ মালিকরা।
গতকাল সকালে রাজধানীর গুলিস্তান, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ঘুরে দেখা গেছে, বৃষ্টির কারণে অনেকে সময়মতো বাস কাউন্টারে পৌঁছাতে না পারায় বাস বিলম্বে ছাড়ছে। বৃষ্টির কারণে সড়কগুলোতে জটলা তৈরি হয়েছে। বাস টার্মিনালগুলোর আশপাশে ছাউনির নিচে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে অনেককে।
বাস কর্তৃপক্ষ বলছে, বৃষ্টির কারণে অনেক যাত্রী সময়মতো আসতে পারেনি। ফলে সময়মতো বাস ছাড়া যায়নি। আবার অনেক যাত্রী আগে এসে বৃষ্টিতে বিপত্তিতে পড়েছে। বৃষ্টির কারণে বাস স্টপেজে আসতে দেরি হওয়ার কারণে কিছু যাত্রী বাসও মিস করেছেন।
খুলনাগামী যাত্রী আজাদ মিয়া জানান, বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় গাড়ি পাননি। ফলে সায়েদাবাদ বাস স্টপেজে আসতে দেরি হয়েছে। তার জন্য বাস বিলম্ব করলেও আরেকটু দেরি হলে হয়তো বাস মিস করতেন।
রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গতকাল মঙ্গলবার ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। টিকিটবিহীন যাত্রীদের ক্ষেত্রে এবার কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কোনো যাত্রী বিনা টিকিটে স্টেশন এলাকায় প্রবেশ করতে পারেননি। এবারের ঈদযাত্রায় তেমন কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ ট্রেন সময়মতো ছাড়লেও দু-একটি ট্রেন দেরিতে ছেড়েছে। সকালে ধূমকেতু এক্সপ্রেসে যাত্রী এমজেড আবেদিন বলেন, আগের দিন সোমবার তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ঢাকা ছাড়েন। তাদের ট্রেনটি যথাসময়ে রাজশাহীর উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে। যাত্রায় কোনো বিলম্ব হয়নি। কিন্তু মঙ্গলবার তাকে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোররাত থেকেই সায়েদাবাদসহ আশপাশের যাত্রাবাড়ী, দোলাইরপাড়, শনিরআখড়া, ফুলবাড়িয়া থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের নিয়ে অনেক গাড়ি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সায়েদাবাদে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো গন্তব্যে দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা।
বরিশালের যাত্রী জালাল উদ্দিন বলেন, আমি বরিশালের বাকেরগঞ্জে যাব। ভোর ৪টায় আমি বাসস্ট্যান্ডে আসি। ইলিশ পরিবহনে অন্য সময় ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হলেও আজ (মঙ্গলবার) ৬০০ টাকা নিয়েছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবারের ঈদে যানজট ও জনজট নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশংসনীয় তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে ঈদযাত্রার বিভিন্ন রুটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের পথে বিভিন্ন রুটে সোমবার যাত্রীভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। চট্টগ্রাম থেকে ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ উত্তরবঙ্গের পথে যাত্রীপ্রতি দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে ফেনীর যাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামের ভাড়া। আর ঢাকা থেকে সাতকানিয়া বা আমিরাবাদের যাত্রীদের কক্সবাজারের ভাড়া গুনতে হচ্ছে। একইভাবে ঢাকা থেকে বগুড়ার যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে।
মোজাম্মেল হক আরও বলেন, নৌপথেও কূটকৌশলের ফাঁদে পেলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনো টিকিট অব্যবস্থাপনা, টিকিট কালোবাজারি, অপরিকল্পিত যানবাহন ব্যবস্থাপনাসহ নানা ক্ষেত্রে ঈদ ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকায় যাত্রীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব ভাড়া নৈরাজ্যের প্রতিরোধে বিআরটিএ ও বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে প্রতিবছর ঈদে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ভিজিল্যান্স টিম বা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে কোথাও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
গাজীপুরে ভাড়া-নৈরাজ্য : গণপরিবহন সংকট ও অতিরিক্ত ভাড়া এড়াতে খোলা ট্রাক-পিকআপে চড়ে ছুটছে মানুষ। মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদযাত্রায় বাসে দ্বিগুণ বা এর বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তাই গণপরিবহনের চেয়ে কম ভাড়ায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য ঈদে ঘরে ফেরা মানুষ ট্রাক-পিকআপে চলাচল করছে। ভাড়া নিয়ে তেমন নজরদারি না করায় অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ফলে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক-পিকআপে চড়ছে মানুষ।
গতকাল দুপুরের পর থেকে শিল্পকারখানাগুলো ছুটি হতে থাকায় সড়কগুলোতে যাত্রীদের চাপ বাড়ে। তবে দূরপাল্লার পরিবহন সংকটে অনেককেই সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে ৩০০ টাকায় যাত্রী তুলছিলেন ট্রাকচালক লিয়াকত। তিনি বলেন, গতকাল রাতে ঢাকায় কাঁচামাল নিয়ে ঢুকেছিলাম। সকালের দিকে যাত্রী কম থাকায় বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে ট্রাক নিয়ে বের হয়েছি। এখন সড়কে অনেক যাত্রী, খালি যাওয়ার চাইতে ঈদের আগে কিছু টাকা আয় হবে।
লিয়াকতের ট্রাকে করে ময়মনসিংহে যাচ্ছিলেন মো. আজিজুল। আজিজুল জানান, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে বাসে উঠতে পারিনি। ঢাকা থেকে যে বাসগুলো ময়মনসিংহ যাচ্ছে, তা যাত্রী পরিপূর্ণ। ভাড়া নিচ্ছে অনেক বেশি। ট্রাকে ৩০০ টাকায় ময়মনসিংহের বাইপাস পর্যন্ত যাচ্ছি। বাসের চাইতে কম ভাড়ায় যেতে পারব। বৃষ্টি ঠেকাতে সঙ্গে ছাতাও নিয়েছেন।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক : উত্তরবঙ্গের পরিবহনগুলো ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চার লেনের সুবিধাভোগ করলেও এলেঙ্গা হতে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কে ঘটছে বিপত্তি। এখানে সোমবার রাতভর যানজটে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রী ও চালকদের।
গতকাল বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় থেকে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার হাতিয়া পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এর আগে সোমবার রাত ১২টা থেকে গতকাল ভোর ৫টা পর্যন্ত এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার অংশে যানজট ছিল। তবে যানজট হলেও থেমে থেমে গাড়ি চলছিল।
সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে চাপ দ্বিগুণ : গতকাল সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে যানবাহনের চাপ স্বাভাবিক সময়ের থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়। সোমবার রাত থেকে শুরু করে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এই মহাসড়কে যানবাহনের চাপ থাকে। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ১০ থেকে ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করত, সেখানে ঈদের এই মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার গাড়ি চলাচল করে। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থেকে মুলিবাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তায় ধীরগতিতে যান চলাচল করে। মূলত টোলপ্লাজায় টোল আদায়ে বিলম্ব হওয়ার কারণে এই ধীরগতি হয়েছে।
দৌলতদিয়া ঘাটে দুর্ভোগ নেই : দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে গতকাল ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রীর চাপ বেড়েছে। তবে ঘাটে নেই কোনো দুর্ভোগ। ফেরি পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীরা বিভিন্ন যানবাহনে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন।
ঢাকা থেকে ঘরমুখো যাত্রী আলাউদ্দিন বলেন, বিগত বছরগুলোতে ঘাটে এসে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এ বছর বৈরী আবহাওয়া থাকলেও ফেরিতে পার হতে পেরেছি। আমেনা বেগম নামের এক যাত্রী বলেন, একদিন আগে আসতে পেরে শান্তিতে ঘরে ফিরতে পারছি। ঘাটে এসেও কোনো দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে না। লঞ্চের চেয়ে ফেরিতে বেশি যাত্রী পার হচ্ছেন।
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে যানজট নেই : স্বস্তিতে বাড়ি ফিরছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ। এবার ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির চাপ বাড়লেও যানজট দেখা যায়নি। যানবাহনের চাপ নেই টোলপ্লাজা এলাকায়ও। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা এলাকা ও ঢাকা-মাওয়া ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৩ কিলোমিটার অংশে থেমে থেমে যাত্রা : মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১৩ কিলোমিটার এলাকায় যানবাহনের ব্যাপক চাপ বেড়ে যায় গতকাল বিকালে। জামালদী মেঘনা সেতু থেকে বাউশিয়া পাখির মোড় পর্যন্ত ধীরগতিতে চলে যানবাহন। এতে ভোগান্তি পড়ে ঘরমুখী মানুষের। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সরেজমিনে এ চিত্র দেখা গেছে।
ভবেরচর এলাকায় কুমিল্লাগামী যাত্রীসেবা পরিবহনের বাসচালক মাসুম মিয়া সঙ্গে কথা হয় বিকাল পাঁচটার দিকে। তিনি বলেন, জামালদী পর থেকে ভবেরচর পর্যন্ত থেমে থেমে আসতে হয়েছে। যানবাহনের চাপের কারণে একটু একটু করে যেতে হচ্ছে। সৌদিয়া পরিবহনের যাত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, পরিবারবর্গ নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ঢাকা থেকে দুপুর দেড়টার দিকে দাউদকান্দি বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। পথে জামালদী থেকে ভবেরচর আসতেই আধাঘণ্টার ওপরে লাগে।
ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসএম রাশেদুল ইসলাম বলেন, একদিকে যানবাহনের চাপ, অপরদিকে ভবেরচর পশুর হাটে যাতায়াত, ট্রাক থেকে পশু নামানো, পশুর চলাচলে ধীরগতিতে চলছে যানবাহন। সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করছেন।