টার্গেট বাণিজ্য বলি রোগী

Slider বাংলার মুখোমুখি


সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় চিকিৎসকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গাইনি থেকে শুরু করে পুষ্টিবিদেরা পর্যন্ত নিজেদের নামে ফেসবুক পেজ খুলে চিকিৎসাবিষয়ক নানান তথ্য দিচ্ছেন। তাদের ভাষ্য- মানুষের সচেতনতা বাড়াতেই এমন উদ্যোগ; কিন্তু তাদের মধ্যে এক শ্রেণির চিকিৎসক রয়েছেন, যাদের মূল লক্ষ্য বাণিজ্যিক অর্থাৎ ব্যাপক পরিচিতি লাভের মাধ্যমে বেশি বেশি রোগী বাগিয়ে নেওয়া। আর তাদের এহেন আর্থিক লোভের বলি হতে হচ্ছে রোগীদের। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেওয়া কুমিল্লার আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যু এর সর্বশেষ সাক্ষী। যদিও আচরণবিধি অনুযায়ী বাণিজ্যিক লক্ষ্যে চিকিৎসকদের প্রচার-প্রচারণা চালানো অত্যন্ত গর্হিত ও নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা সামাজিক মাধ্যমে যতটা তৎপর, তা বিশে^র কোথাও নেই। চিকিৎসকদের এমন তৎপরতার লক্ষ্য সচেতনতা তৈরিতে যতটা, তারচেয়ে বেশি রোগী টানতে। লাইভ সম্প্রচারের কারণে রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশের পাশাপাশি হারাচ্ছে চিকিৎসা পেশার সংবেদনশীলতা। এমতাবস্থায় চিকিৎসকদের এসব কর্মকা- কতটা আইনসিদ্ধ- তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার অনুসারীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। নিজের চেম্বার থেকেই শুধু নয়, অপারেশন থিয়েটার থেকেও ফেসবুক লাইভে আসেন তিনি। এসব লাইভে অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান প্রসবে নিজের সফলতার কথা বলে থাকেন এই চিকিৎসক। সর্বশেষ গত ৭ জুন প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সংযুক্তা সাহা কয়েক নারীকে দেখাচ্ছেন, যাদের অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান হয়েছে। এ সময় তাকে বলতে দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে নরমাল ডেলিভারির জন্য রোগীরা আসছেন।

স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের এমন চমকপ্রদ প্রচার-প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে প্রসববেদনা নিয়ে গত ৯ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার পরিবার। কিন্তু ওই চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে ওই হাসপাতালে প্রসব করাতে গিয়ে প্রথমে নবজাতক, পরে প্রসূতিরও মৃত্যু হয়। আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর পর ওই হাসপাতালে সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা প্রদান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল সোমবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ ঘটনার জন্য সংযুক্তা সাহাকে দায়ী করেছে।

একই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচার চালানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে ডা. সাহার সঙ্গে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগযোগ করা হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

সংযুক্তা সাহার মতো যেসব চিকিৎসক সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, তেমনই আরেকজন পুষ্টিবিদ আয়েশা সিদ্দিকা। রাজধানীর ঝিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ হাসপাতালে কর্মরত এই চিকিৎসকের ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা ২ লাখ ৩২ হাজারের বেশি।

ভিটামিন ডি-এর ওপর তার একটি ভিডিও গত ৯ জুন ভাইরাল হয়। এতে ডা. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, সূর্যের আলোতে পানি রাখলে সেই পানিতে ভিটামিন ‘ডি’ যুক্ত হয়। ভিটামিন ডি পেতে পানির বোতল এক থেকে দেড় ঘণ্টা রোদে রাখার পরামর্শ দেন তিনি। ভিডিওটির কয়েক হাজার শেয়ার হয়। এ তথ্য দিয়ে পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসক ছাড়াও অন্যান্য পেশায় যুক্ত অনেকের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ডা. আয়েশা।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, পানিতে বা পানির মাধ্যমে ভিটামিন ডি পাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত কোনো ভিত্তি নেই। একজন চিকিৎসকের এমন অবৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। সমালোচনার মুখে গত বুধবার নিজ ফেসবুক পেজে এক ভিডিওবার্তায় ক্ষমা চান এবং দুঃখ প্রকাশ করেন ওই পুষ্টিবিদ।

বিষয়টি নিয়ে পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকার সঙ্গে কথা বলতে ফেসবুক পেজে দেওয়া তার নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এক নারী ফোন ধরেন। তিনি অনুমতি ছাড়া ম্যাডামের নম্বর দেওয়া নিষেধ বলে জানান।

বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়াবেটিকস ফোরামের সভাপতি শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘উনি (আয়শা সিদ্দিকা) যেটা বলেছিলেন তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। যদি কোনো পুষ্টিবিদ এমন কোনো তথ্য বা বক্তব্য দেন তবে তার দায়ভার সম্পূর্ণটাই তার নিজের। বিষয়টি নিয়ে ওনার সঙ্গে কথা হয়েছে। পরে তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। আমাদের উচিত এমন কোনো তথ্য না দেওয়া, যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের তথ্যমতে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি চিকিৎসক। এর মধ্যে সরকারি ৩৩ হাজার এবং বেসরকারি ৮৭ হাজার।

এসব চিকিৎসকের মধ্যে কম বয়সীদের সংখ্যাও কম নয়। তাদের বড় অংশই রাজধানী ঢাকায় কর্মরত। এমন চিকিৎসকদের মধ্যে ১০ শতাংশই সামাজিক মাধ্যমে বেশ তৎপর বলে জানান সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা। নিজের পৃথক ফেসবুক পেজ আছে- এমন চিকিৎসকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যাদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের নিচে।

চিকিৎসকদের পেজ পরিচালনা করেন এমন কয়েক অভিজ্ঞ অ্যাক্টিভিস্ট জানান, জনপ্রিয়তা বাড়লে রোগী বাগানো সহজ হয়। তাই নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ভিডিও করে প্রচার করা হয়। এ জন্য পেজ পরিচালনা করতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থও দেন চিকিৎসকেরা। আবার অনেকে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে টক-শোতে যান উল্টো নিজ থেকে টাকা দিয়ে। টক শোতে গেলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে বলে মনে করেন এসব চিকিৎসক। এমনকি ডাক্তাররা নিজেদের অর্থায়নে টেলিভিশন অনুষ্ঠান পর্যন্ত পরিচালনা করছেন।

মো. রিয়াসাত আজিম। অন্তত ২০ চিকিৎসকের পেজ পরিচালনা করে আসছেন তিনি। আমাদের সময়কে রিয়াসাত বলেন, ফেসবুক পেজ অনেকেরই আছে; কিন্তু সক্রিয় থাকেন কম। রোগী সামলিয়ে, পরিবারকে সময় দিয়ে পেজের জন্য সময় দিতে পারেন না অধিকাংশ চিকিৎসক।

তবে ভিন্ন কথা বলেন আরেক অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বহু চিকিৎসকের পেজ পরিচালনা করেছি। ৪০ বছর বয়সের কাছাকাছি চিকিৎসকদের মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশেরই ফেসবুক পেজ রয়েছে। এর মধ্যে কেউ নিজে আবার অনেকে কারও মাধ্যমে চালান। তবে দিন দিন এ প্রবণতা বাড়ছে।

দেশের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা বলছেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে রোগী আকৃষ্ট করা অনৈতিক। কোনো চিকিৎসকের প্রচারের মাধ্যমে কেউ প্রতারিত হলে কিংবা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলায় মারা গেলে এর দায় সেই চিকিৎসকের কাঁধেই বর্তাবে।

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম আমাদের সময়কে বলেন, চিকিৎসকের ভিডিও দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যদি কোনো রোগী ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলার শিকার হন, তার দায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ওই চিকিৎসকেরও। এটি মনিটরিংয়ের কোনো সিস্টেম না থাকায় এ অবস্থা হচ্ছে। ভিডিওতে যে তথ্য দেওয়া হয়, সেটি আদৌ সঠিক কিনা সেটি চেক করা হয় না। সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষও বুঝবে না। তারা গুগলে সার্চ দিলে যে তথ্য পাচ্ছে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর এতেই ঘটছে বিপত্তি। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা সামাজিক মাধ্যমে কতটুকু বলতে পারবেন, তা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। জনপ্রিয়তা বাড়াতে, রোগী টানতে কিংবা মুনাফার উদ্দেশ্যে এগুলো হচ্ছে কিনা- তা মনিটরিং করবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। তাদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।

উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্য ডা. নিরুপম দাশ আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা সোশ্যাল মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বাড়াতে যতটা তৎপর, তা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। উন্নত দেশগুলোতে এমন কোনো কিছুই পাবেন না। চিকিৎসকদের এসব বিজ্ঞাপনের কারণে অনেক রোগীই বিভ্রান্ত হন। এজন্য এগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, একাডেমিক, পরামর্শ-সচেনতনামূলক ভিডিও দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু রোগী আকৃষ্ট করতে কোনো প্রচার চালানো, এমনকি নির্দিষ্ট করে কোনো ওষুধের নাম বলাটাও মেডিক্যাল অ্যাথিকসের (চিকিৎসা নৈতিকতার) পরিপন্থী। সেন্ট্রাল হাসপাতালে যেটি হয়েছে, এমন বিজ্ঞাপন কোনো চিকিৎসক দিতে পারেন না। এটি স্পষ্ট প্রতারণা। এ বিষয়ে বিএমডিসির যে নির্দেশনা, সেটি অনেক পুরনো। যুগোপযোগী করে নীতিমালা করা দরকার।

চিকিৎসকরা কীভাবে কাজ করবেন, তা পরিচালনা করে বিএমডিসি। এ জন্য সংস্থাটি প্রণীত একটি কোড অব প্রফেশনাল কন্ডাক্ট রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে- কোনো চিকিৎসক তার পেশার পসারের জন্য প্রচারমূলক কার্যক্রম চালাতে পারবেন না। তবে সেখানে সোশ্যাল মাধ্যম ব্যবহার ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই।

অবশ্য বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেন জানিয়েছেন, বিএমডিসির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে সোশ্যাল মাধ্যম ব্যবহারের বিষয়টি যুক্ত করার কথা এসেছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, সোশ্যাল মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবসায়িক মানসিকতায় রোগী বাগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটি মেডিক্যাল অ্যাথিকসের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে শিগগিরই আমরা বসব এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *