দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই ধারায় এগোচ্ছে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটির বড় একটি অংশ দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জিএম কাদের) সঙ্গে আছেন। আর জিএম কাদের যাদের দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন কিংবা বহিষ্কার করেছেন- এমন নেতাদের নিয়ে দলের সম্মেলন ও আগামী সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনা আঁটছেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকার অভিপ্রায়ে রওশন প্রতিনিয়ত সরকারের গুণকীর্তন করে যাচ্ছেন। তার অনুসারী নেতারাও একই মানসিকতা প্রদর্শন করছেন। তবে জিএম কাদের কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রওশন শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবেন। আর পরিস্থিতি বুঝে অর্থাৎ যারা ফের ক্ষমতায় যাওয়ার পথে থাকবেন, তাদের সঙ্গেই জোট করবেন জিএম কাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি সচেতনভাবে কিংবা ‘অদৃশ্য নির্দেশনায়’ দুই ধারায় বিভক্ত থাকে। একেকবার একেক সমস্যা নিয়ে দুই ধারায় বিভক্ত হয় দলটি। বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোর আগে ও পরে এমনটিই দেখা গেছে।
সাম্প্রতিককালে রওশন এরশাদের পাশাপাশি রওশনপন্থি নেতা ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাও সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের ‘উন্নয়নের ফিরিস্তি’ তুলে ধরে জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য দিচ্ছেন। এ ছাড়া রওশনের অন্যান্য অনুসারীও সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করে চলছেন। ফলে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকার পথেই আছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েই যাচ্ছেন। মহাসচিব ‘ঈষদুষ্ণ’ সমালোচনা করলেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে যাচ্ছেন দলের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি আমেরিকাসহ কয়েকটি দূতাবাসে বৈঠকের পর জিএম কাদের আরও বেশি করে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় নেমেছেন। বর্তমান সরকার দেশকে দেউলিয়া করে ফেলেছেনÑ এমনটিও তিনি বিভিন্ন আলোচনায় দৃঢ়ভাবে তুলে ধরছেন।
এ অবস্থায় জিএম কাদেরের নির্বাচনী ভাবনা কী তা এখনো স্পষ্ট না করলেও পরিস্থিতি বুঝে তারা নির্বাচনী জোটে যাবেন বলে দল থেকে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রওশন শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবেন। আর ‘পরিস্থিতি বুঝে’ অর্থাৎ যারা ফের ক্ষমতায় যাওয়ার পথে থাকবেন, তাদের সঙ্গেই জোট করবেন জিএম কাদের। এমন বাস্তবতায় রওশন ও জিএম কাদেরের দুই ধারার রাজনীতির শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা সমীকরণ তৈরি হলে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন এবং জাপা থেকে ৩৪ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। উপনেতা হন জিএম কাদের। ওই নির্বাচনে আগে এরশাদের ‘রহস্যজনক অসুস্থতা ও সিএমএইচে ভর্তি থাকা’ নিয়ে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্ট হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে যান শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।
২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে জাতীয় পার্টি। একপর্যায়ে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এরশাদ। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উপনেতা বানান ছোটভাই জিএম কাদেরকে। এর কিছু দিন পরেই জিএম কাদেরকে সরিয়ে পুনরায় উপনেতা বানান স্ত্রী রওশন এরশাদকে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ মেটেনি।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ঢাকা জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার মো. মুনীর হোসাইন খানের কাছে রওশনের অনুসারী ঢাকা-১৭ আসন উপনির্বাচনে লাঙলের প্রার্থী হিসেবে কাজী মামুনুর রশীদ নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রার্থী কাজী মামুনুর রশীদ, রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন, সাবেক সংসদ সদস্য এমএ গোফরান, সাবেক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা রফিকুল হক হাফিজ, জাপা নেতা অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, মিজানুর রহমান দুলাল, জহির উদ্দিন জহির, শাহ আলম তালুকদার, ইসরাফিল হোসেন মিয়া, আমিনা হাসান, হাসনা হেনা, মঞ্জুরুল হক সাচ্চা, এজাজ আহমেদ, এম মুহিবুর রহমান, সাজিউল ইসলাম রকি, ছাত্রনেতা আবু সাঈদ লিয়ন ও মিশু আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, কাজী মামুনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে রিট পিটিশনে লাঙল প্রতীকের ১১৫৩/২০০০ সালের মামলার রায়ের কপি। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে অনুমোদিত ও তৎকালীন মহাসচিব স্বাক্ষরিত দলীয় গঠনতন্ত্রের প্রথম মুদ্রণ কপি।
অন্যদিকে জিএম কাদের মনোনয়ন বোর্ডের সভা করে সর্বসম্মতিক্রমে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দিয়েছেন মেজর (অব) সিকদার আনিছুর রহমানকে। এবং চট্টগ্রাম-১০ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে মো. সামসুল আলমকে।
ঢাকা-১৭ আসনে রওশন এরশাদের প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘এটিকে আমি কোনোভাবেই দেখছি না। এটি একটি প্রচার। বাস্তবে আমাদের পার্টি একটিই। তা হলোÑ জাতীয় পার্টি। আমরা যাকে মনোনয়ন দেব সেটিই দলীয় মনোনয়ন। কে কোন দলের নাম ব্যবহার করছেন তা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সেটি না দেখে, তা হলে জনগণই দেখবে। এটি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন না।’
আগামী নির্বাচনী পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে জিএম কাদের আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচন এলে সবাই কোনো না কোনো জোটে যাবে। প্রশ্নটা হলো আমরা কোন জোটে যাব, নাকি আমাদের সঙ্গে জোটে সবাই আসবে, সেটি নির্ভর করে দুটো শক্তির ওপর। যে দুটো শক্তি প্রধান শক্তি হবে, তাদের সঙ্গে সবাই জোটে যাবে। তিনি বলেন, যারা প্রধান হতে পারবে, তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। আমরা তো এখনো জানি না। সামনে নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি বুঝলে আমরা সেটি মূল্যায়ন করতে পারব।’
রওশনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’
অন্যদিকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের মুখপাত্র ও ঢাকা-১৭ আসনে রওশনে লাঙল প্রতীকে মনোনয়নপ্রত্যাশী কাজী মামুনুর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে আগামী নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যাব।’
ঢাকা-১৭ আসন উপনির্বাচনে তিনি কেন লাঙল প্রতীক পাবেন এর যুক্তি জানতে চাইলে কাজী মামুনুর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ পার্টির সর্বোচ্চ ক্ষমতা রাখেন। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের রায় হলোÑ সংসদে যিনি দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তিনিই লাঙল প্রতীক বরাদ্দ দেবেন। এখন চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের মনোনয়ন দিতে পারেন। কিন্তু রওশন এরশাদ যদি কোনো অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি দিতে পারেন। এখন নির্বাচন আইন অনুযায়ী যা মেনে নেয়, আমরা তা মেনে নেব।’