দেশের রাজনীতিবিদ এবং বর্তমান সরকার যখন আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের রূপরেখা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত, তখন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা নেমেছেন অন্যরকম অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে। সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমীন মারা যাওয়ার সপ্তাহ যেতে না যেতেই চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাহাড়তলী) আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন এ শহরের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা। কারণ এই আসনের এমপি হওয়া মানে নগর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বড় স্বীকৃতি অর্জন করা। যদিও সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ডা. আফছারুল আমীনের মৃত্যুর পরপরই এ নিয়ে কথা বলাকে অরুচিকর বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের এই নেতারা।
ডা. আফছারুল আমীন গত ২ জুন মারা যান। স্বাভাবিকভাবেই এ আসনে উপনির্বাচনের প্রশ্ন আসছে। এ মুহূর্তে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে নেই। তাই আওয়ামী লীগ থেকে যিনিই মনোনয়ন পাবেন, তিনি এমপি হবেন। এ চিন্তা থেকেই আসনটিতে নিজের অবস্থান জানান দিতে চান নেতারা। নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার আসন শূন্য ঘোষণার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গতকাল নির্বাচন কমিশন এই আসনের উপনির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করেছে। তফসিল অনুযায়ী উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হবে ৩০ জুলাই।
তবে আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র মতে, আগামী আগস্ট থেকে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে রাজনীতির দৃশ্যপট। সে রকম কিছু হলে এই উপনির্বাচন নাও হতে পারে। আর যদি উপনির্বাচন হয়ও, নির্বাচিত এমপি সংসদের মেয়াদ পাবেন তিন থেকে চার মাস। এর পরও প্রভাবশালী নেতারা ওই আসনে নিজেদের দেখতে মরিয়া। কারণ চট্টগ্রামের রাজনীতিতে চট্টগ্রাম-৯ ও চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্যের বিশেষ প্রভাব ও কদর আছে।
অথচ এক মাস আগে চট্টগ্রাম-৭ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনের উপনির্বাচনে এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দেখা যায়নি। ওই আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। আওয়ামী লীগ এ প্রভাবশালী নেতার পরিবর্তে অনেকটা আলোচনায় না থাকা নোমান আল মাহমুদকে মনোনয়ন দেয়। চট্টগ্রাম-১০ আসনে যে চারজন মনোনয়ন নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তাদের দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা, অন্য দুজন অপেক্ষাকৃত তরুণ।
তারা হলেন- চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ। এর বাইরে বিএনপির সমর্থন নিয়ে জয়ী হওয়া সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের নামও শোনা যায় আওয়ামী লীগের হয়ে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক তালিকায়। তবে মনজুর আলম আমাদের সময়কে বলেন, এ আসনে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগে যোগ্য প্রার্থী আছেন। তাই আমি এ নিয়ে ভাবছি না। মনজুর আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন আনারস মার্কায়। পেয়েছিলেন প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩ শতাংশ। তবে এর দুই বছর পর বিএনপির সমর্থন নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের মেয়র হয়েছিলেন। হারিয়ে দিয়েছিলেন তিন বারের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন চসিকের মেয়র পদকে সামনে রেখেই এতদিন রাজনীতি করেছেন। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের মেয়রও ছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালে মেয়র পদে মেয়াদ শেষে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি নগরীর একটি আসনে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এমন বার্তা তার অনুসারীরা ছড়িয়ে দেন। এর মধ্যে আ জ ম নাছির উদ্দীন গত ৫ জুন বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, সামগ্রিক রাজনীতি, বিরোধী দলের অপপ্রচার মোকাবিলা ও আগামী নির্বাচনে করণীয় ঠিক করতেই মূলত কথা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
খোরশেদ আলম সুজন হজ পালন উপলক্ষে সৌদি আরব অবস্থান করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছাড়াও চসিকের সাবেক প্রশাসক। সম্ভাব্য উপনির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নেত্রী যখন যে দায়িত্ব আমাকে দেবেন, আমি তা সুচারুভাবে পালন করব।
চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে থাকা চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ এ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মহিউদ্দিন বাচ্চু আমাদের সময়কে বলেন, বিগত বছরগুলোতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন ছাড়াও গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিই। যুব সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলাম। দলের কঠিন সময়ে মাঠেই ছিলাম। এখনো মাঠে আছি। প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো দায়িত্ব দেন, তা হলে তা শতভাগ সততার সঙ্গে পালন করব।
সাবেক যুবলীগ নেতা ফরিদ মাহমুদ বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন নগণ্য কর্মী। সংগঠনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সবসময় কাজ করি। সংগঠনের হয়ে কোনো পদ পেলেও কাজ করব, না পেলেও করব। সবই প্রধানমন্ত্রীর মর্জি।
ডা. আফছারুল আমীন এ আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কাছে হেরে যান। ২০০৮ সালে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন। ২০১৩ ও ২০১৮ সালেও তিনি এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সবার কাছে ডা. আফছারুল আমীনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তাই তার মৃত্যুর পরপরই নির্বাচন নিয়ে সরাসরি কোনো নেতা কথা বলছেন না, তা জানিয়ে দিয়েছেন আকারে ইঙ্গিতে।