অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১০ বছর অনুসন্ধান শেষে সোয়া কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে তার নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে টাকা পাচার, ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ১২টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৩ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেলেও সব বিষয় এ মামলায় উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া বিদেশে ভাগ্নের কাছে ৫০ লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন এজাহারে বলা হলেও সংশ্লিষ্ট মানিলন্ডারিং ধারা মামলায় উল্লেখ নেই।
গতকাল সোমবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা ১-এ প্রশান্ত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। কমিশনের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক এ তথ্য জানিয়েছেন।
মামলায় আসামির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়। তবে দুদকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ মামলায়
সাবেক এই সচিবের বিরুদ্ধে ১ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ২৪৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হলেও তার বিরুদ্ধে আসা অন্য অভিযোগগুলোর অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।’
প্রশান্ত কুমার রায় আমাদের সময়কে বলেন, তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। তিনি যে সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা চাকরি ও পারিবারিক সূত্রে বৈধভাবে অর্জন করেছেন।
এদিকে আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে সরকারি চাকরির পাশাপাশি দুটি ব্যবসায়িক কোম্পানিতে সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায় বেনামে বিনিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
২০১৬ সালে কমিশনের তৎকালীন সচিব আবু মো. মোস্তফা কামালের স্বাক্ষরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তৎকালীন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব প্রশান্ত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ব্যবসা পরিচানার কথা উল্লেখ করা হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, প্রশান্ত কুমার রায় মেসার্স ডেনিম পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ এবং মেসার্স ডেনিম এক্সপোর্ট প্রসেসিং লিমিটেড নামক দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিষয়টি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৬-এর লঙ্ঘন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনকে অবহিত করতেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, দুদকের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশান্ত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি ডেনিম পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ ও ডেনিম এক্সপোর্ট প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেন প্রশান্ত কুমার রায়। বেশ কয়েকটি শর্তে এ দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে থাকা তার শেয়ারের ৫০ শতাংশ এনামুল হক নামে এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর কাছে দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করেন। এ সংক্রান্ত নথিপত্র আমাদের সময়ের হাতে রয়েছে। পরবর্তীকালে প্রশান্ত কুমারের কাছে ওই বিনিয়োগের অর্থ ফেরত চেয়েছিলেন এনামুল হক। কিন্তু তিনি ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রশান্ত কুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এই সচিব বলেন, ‘কখনো আমার কোনো কোম্পানি ছিল না। এমন অভিযোগ আগেও উঠেছিল, এগুলো ভুয়া। এগুলোর কোনো প্রমাণ দুদক পায়নি। আমি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছি। এ বিষয়টি যাদের স্বার্থে লাগতে পারে, হয়তো তারা এখন আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।’ এনামুল হকের দাবির বিষয়গুলো আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
তবে এনামুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘তৎকালীন একজন সচিবের মাধ্যমে প্রশান্ত কুমার রায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে ডেনিম পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ ও ডেনিম এক্সপোর্ট প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়েছিলেন। তার কথায় আশ^স্ত হয়ে দুই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারি কোম্পানিগুলো তার বন্ধুদের নামে। পরে তার কাছে টাকা চেয়েও ফেরত পাইনি।’
প্রশান্ত কুমার রায়ের দুই মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেন। তার মেয়েরা স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছেন বলে দুদকের কাছে দাবি করেন। তবে দুদকের অনুসন্ধান রেকর্ডপত্র বলছে, তার দুই মেয়েকে পড়াশোনা করানোর জন্য ব্যাংকিং মাধ্যমে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। বৈধভাবে এই অর্থ পাঠানোর পাশাপাশি তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বলে দুদকের তথ্য-প্রমাণ এসেছে। এ বিষয়ে দুদক থেকে এমএলএআর পাঠানোসহ বিস্তারিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে দুদক।
এদিকে প্রশান্ত কুমার রায়ের নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় চারটি ফ্ল্যাট থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। তিনি ২০১৩ সালে কাটাসুরে ১ হাজার ৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, একই বছর কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যে একটি ফ্ল্যাট, ২০১৬ সালে আদাবরে ৯০০ বর্গফুটের একটি এবং ২০১৮ সালে সরাই জাফরাবাদে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনেন।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রশান্ত কুমারের নামে ১২টি ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। ২০০৪ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব ব্যাংক হিসাবে ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা জমা এবং ১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে এ ধরনের লেনদেনকে ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া তার নামে সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র, পৈতৃক জমিনে দোতলা বাড়ি, ২৩ লাখ টাকার একটি জাপানি প্রিমিও গাড়ি, ১৬ লাখ টাকার একটি এক্সকাভেটর, ঢাকার গ্রীন সুপার মার্কেটে ৩০০ বর্গফুটের একটি দোকানসহ অন্যান্য সম্পত্তি রয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৭ সালে প্রশান্ত কুমার তার ভাগ্নে মনোজ কুমার বিশ্বাসের কাছ থেকে খুলনার বটিয়াঘাটা থানা এলাকায় ৫ দশমিক ৮০ একর জমি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে মালিক হন। এভাবে তিনি এই জমির মালিক হয়ে মোট ১ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। তার অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে এই পথ অবলম্বন করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এ ছাড়া প্রশান্ত কুমারের বিরুদ্ধে জমি বিক্রির অর্থ থেকে ভাগ্নের কাছে ৫০ লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে প্রশান্ত কুমার রায় ২০১৪ সালে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক থাকাকালে প্রকল্পের প্রচারের কথা উল্লেখ করে ‘কিস্তির জ¦ালা’ নামক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে এ চলচ্চিত্রের নির্মাণ করা হলেও বিএফডিসির পাওনা ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা মওকুফ করিয়ে নেন তিনি।