বছর ঘুরে আসে জাতীয় বাজেট। একই সঙ্গে আলোচনায় থাকে কোন পেশার লোকের জন্য কী বরাদ্দ থাকছে। এ নিয়ে আগ্রহী থাকেন পেশাজীবীরা, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার হিসাব মেলানো নিয়ে। তবে বাজেটে শিক্ষক সমাজ, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন খুব কমই হয়ে থাকে। বেসরকারি শিক্ষকদের কারও চাওয়া চাকরি জাতীয়করণ, কারও সরকারি বেতনের অংশ (এমপিও) বৃদ্ধি, কারও এমপিওভুক্তি, এমপিওভুক্তদের সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা প্রদান, চাকরি শেষে অবসর ও কল্যাণ তহবিলের টাকা দ্রুত প্রাপ্তি। এসব দাবিতে তারা অনশন, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, সরকারি দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান, সংবাদ সম্মেলনও করেন বিভিন্ন সময়ে। এভাবে তাদের অনেকেরই চাকরি জীবন শেষ হয়ে যায়। কারও কারও স্বপ্ন পূরণে হলেও অধিকাংশের জীবনাবসান ঘটে অপ্রাপ্তি নিয়ে।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ঘোষণা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি শিক্ষকরা। তারা বলছেন, শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড তৈরি করলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেননি বাজেট আলোচনায়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের লিখিত বক্তব্যের ৪৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘শিক্ষা খাত’ শিরোনামে শিক্ষার বিগত ১৪ বছরের গৃহীত উদ্যোগগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি’ আমাদের বিশেষ অঙ্গীকার। শিক্ষা খাতে বিগত ১৪ বছরে আমাদের অনুসৃত নীতি- কৌশল ও লক্ষ্যাভিমুখী সম্পদ সঞ্চালনের সুফল আমরা পেয়েছি। এর সুস্পষ্ট প্রতিফলন আমরা আর্থ-সামাজিক চলকগুলোর অগ্রগতি থেকে দেখতে পাচ্ছি। আজকের শিশুরাই আমাদের উন্নত-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেবে। তাই শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতসহ যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সক্ষম করে তুলতে চাই। আমাদের চাওয়া হলো বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাবর্ধক, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সহায়ক এবং সেবার মানসিকতা, দায়িত্ব ও বিবেকবোধ জাগ্রত করার উপযোগী শিক্ষা প্রদান।
তবে শিক্ষকদের অভিযোগ, শিক্ষার উন্নয়নে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান বেশি হলেও তাদের বেতনভাতার হিস্যার দাবি মনে ধরেনি বাজেট প্রণেতাদের। অথচ এই শিক্ষকদের ওপর ভর করেই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির নতুন কারিকুলাম। এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের কোনো রূপরেখা নেই প্রস্তাবিত বাজেটে।
নন-এমপিও শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার আমাদের সময়কে বলেন, বাজেট বক্তব্যে সরকারের নীতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটা ঘোষণা থাকে। আমরা দেখলাম, এবারের বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য কিছুই আলোকপাত করা হয়নি। তিনি বলেন, শিক্ষার নতুন কারিকুলাম করেছে সরকার। এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকদের ভূমিকা বেশি হলেও এরাই বেশি বঞ্চিত।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি এমপিওভুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বাশিস) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন তথা শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য নিরসনসহ শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই।
বাশিস সভাপতি বলেন, বেসরকারি শিক্ষকরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। তাদের বাড়ি ভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, সন্তানের শিক্ষা ভাতা একেবারেই নেই। তাদের চাকরিতে কোনো বদলি নেই, যেখানে শুরু সেখানেই শেষ! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা। এদেশের ভূখানাঙ্গা ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানো। অথচ জাতীয় বাজেটে বেসরকারি শিক্ষা খাত একেবারে উপেক্ষিত।
বাজেটে শিক্ষকদের প্রত্যাশার ঘোষণা নিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুফল আসে ধীরে ধীরে। আর তাই সেটা অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত, যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। অর্থনীতিবিদ আর্থার শুলজ্ দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করা সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় ১১ শতাংশ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষার মূল চালিকাশক্তি। তাদের সমস্যাগুলো ভেবে দেখা দরকার। তারা যে পরিমাণ বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে কি দ্রব্যমূল্যের এ সময়ে সংসার চালানো সম্ভব? আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে আর যাই হোক, সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব নয়, যদিও আমাদের মহান শিক্ষকরা সেই অসম্ভবকেও জয় করেছেন, তবুও শিক্ষকদের মধ্যে বিদ্যমান বেতনবৈষম্য দূর করা উচিত।
জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার বাড়ানোর দাবি নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোসহ দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ করার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু তার প্রতিফলন ঘটছে না।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বরাদ্দ থাকছে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ শিক্ষায় টাকার পরিমাণে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ কমেছে।