বাংলাদেশের ১৯৭২-৭৩ সালের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। গত পরশু বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে বাজেট সংসদে উপস্থাপন করলেন তার আকার ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। বলা যায় গত পঞ্চাশ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে হাজার গুণ। এর মধ্যে মানুষের আয় বেড়েছে, তবে বাজেটের হারে তা বাড়েনি। আবার মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বহুগুণ। সে সঙ্গে বাজেটের ঘাটতিও বেড়েছে মারাত্মক পর্যায়ে।
করোনার ক্ষতি পোষাতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আগেই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বড় ধাক্কা এসেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। সারা বিশ্বেই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকেই রয়েছে। ডলারের সংকট আমাদের অর্থনীতির জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। অর্থনীতিতে এই মারাত্মক চাপের ফলেই আমাদেরও প্রবৃদ্ধির হার কমেছে, রিজার্ভ কমেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে, ঋণগ্রস্ত হচ্ছি আমরা, বাজারের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদিকে আগামী ছয়-সাত মাসের মধ্যেই পরবর্তী নির্বাচন। অর্থনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা পরোক্ষ হলেও রাজনীতি বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা প্রায় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দল পনেরো বছরের মধ্যে এখনই সত্যিকারের চাপে পড়েছে। কারণ অর্থনীতি ও রাজনীতি উভয় দিক থেকেই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপ বাড়ছে। সেদিক থেকে প্রস্তাবিত বাজেট সরকারের জন্য তেমন স্বস্তি বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের একটা রূপান্তর ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। স্বপ্ন দেখছি ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব। সে যাত্রাপথ অবশ্যই কুসুমাস্তীর্ণ নয়, তবে এখন আমরা এই যাত্রার সবচেয়ে কঠিন পর্ব পার হচ্ছি। এ সময় রাজনীতিতে যেমন তেমনি অর্থনীতিতেও জাদুকরী কিছু দেখাতে হবে নেতৃত্বকে। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশীজনদের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে কঠিন পর্ব উত্তরণের মতো দিকনির্দেশনা তারা এই বাজেটে পাচ্ছেন না। বস্তুত কেবল আয়, বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব চক্রে বাজেটকে সীমাবদ্ধ না রেখে এতে সংস্কার, নতুন কাজের উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার ইঙ্গিত থাকা দরকার ছিল। আমাদের প্রয়োজন কর ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং খাত এবং মুদ্রানীতির সংস্কার ও উপযুক্ত আইন প্রণয়ন। বাংলাদেশকে পরবর্তী ধাপে সফল হতে হলে তার উপযোগী ভিত্তি তৈরি করতে হবে এখনই।
হিসাব অনুযায়ী বাজেটের আকার প্রতিবছর বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি। এসবই ভালো খবর। কিন্তু মাত্র কদিন আগেই জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অলিভিয়ে ডি শ্যুটার সফরে এসে আমাদের অর্থনীতি নিয়ে যে কথা বলে গেছেন তা বহু বছর ধরে আমরাও বলে যাচ্ছি। কথাটা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত এখনো মজবুত নয়। করোনার এক ধাক্কায় দারিদ্র্য বিমোচনের ধারা যেমন থেমে গিয়েছিল তেমনি নতুন দরিদ্র সৃষ্টিও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সমাজের বিশাল নিম্নবিত্তের মানুষের এমন সঞ্চয় বা সম্পদ নেই যা দিয়ে ব্যক্তিগত, সামষ্টিক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দেওয়া যায়। বস্তুতপক্ষে, কোনো সরকারের পক্ষেই বড় আকারের আকস্মিক বিপর্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। তুরস্কের মতো দেশও ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের মুখে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছিল।
কৃষির যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে, কিন্তু তার শিল্পে রূপায়ণ থেমে আছে, তৈরি পোশাক পরনির্ভরশীল খাত আর রেমিট্যান্স কেবল অদক্ষ শ্রমনির্ভর বলে তারও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অর্থনীতির এই তিন স্তম্ভ দৃঢ় করার জন্য কৃষিশিল্প ও কৃষিতে উৎপাদনের পদ্ধতি এবং পণ্যে বৈচিত্র্য আজ সময়ের দাবি। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ওষুধশিল্পের মতো আরও খাত বের করা দরকার যাতে বিশ্ববাজারে স্থান পাওয়া যায়। আর বহির্বিশ্বের কর্মবাজারে অদক্ষ নয়, দক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবীদের পাঠানোর চিন্তা থেকেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এমনকি বিদেশে কৃষি ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের চিন্তা থেকে পরিকল্পনা সাজানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষিতে আরও নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ শিক্ষা খাতকে শক্তিশালী করে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এ খাতে মানবসম্পদ পাঠানোর কথা ভাবতে পারে। এভাবে ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনায় সাজাতে হবে বাজেট।
বাংলাদেশ এখন কেবল সংকটকাল পার হচ্ছে না, আমরা অতিবাহিত করছি অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল। বাজেটে তার প্রতিফলন ও সে অনুযায়ী পথরেখা থাকা জরুরি। বাজেট শুধু বর্তমানের হিসাব দেবে না, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক রূপরেখাও ফুটিয়ে তুলবে। সেই দূরদর্শী ভাবনার অভাব রয়েছে বর্তমান বাজেটে। বোঝা যায় এটি এমন একটি দলিল যা ক্ষমতাসীন সরকার প্রয়োজন মতো কাটছাঁট ও রদবদল করেই ব্যবহার করবে। এভাবে কি সরকার সংকট থেকে জনগণকে মুক্ত করতে পারবে? বা নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হবে?