বরিশাল সিটি করপোরেশন (বসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। আপন দুই ভাই বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও এবারের মেয়রপ্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর (খোকন সেরনিয়াবাত) মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ নেই। আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থীকে বিজয়ী করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের গঠন করা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির ডাকা বিশেষ বর্ধিতসভায় অংশ নেননি ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। তার ভাতিজা বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গেও আবুল খায়ের আবদুল্লাহর দেখা নেই।
এদিকে, গত শুক্রবার বর্ধিতসভায় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ভেদাভেদ ভুলে দলের নেতাকর্মীদের নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সবাইকে ভোটের মাঠে থাকার নির্দেশনা দিলেও শনিবার নগরীর কোথাও সাদিক সমর্থকদের দেখা যায়নি। ফলে নির্বাচনের মাঠে জয়-পরাজয়ের হিসাবে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে নৌকা প্রতীক।
শুক্রবারের সভা সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আহ্বানে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিরসনে সভার আয়োজন করা হলেও বসিকের বর্তমান প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটু কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে মেয়রপ্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতকে কটাক্ষ করেন। কিন্তু মঞ্চে উপস্থিত খোকন সেরনিয়াবাতের বড় ভাই ও বর্ধিতসভার সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এ সময় নিশ্চুপ ছিলেন। শহরসংলগ্ন একাধিক এলাকা থাকা সত্ত্বেও বরিশালের শেষপ্রান্ত তথা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নির্বাচনী এলাকা গৌরনদীতে সভা আয়োজন করায় আগে থেকেই বিষয়টিকে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় নৌকার প্রার্থী ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীরা তাতে যোগ দেয়নি বলে জানান খোকন সমর্থক এক নেতা। আর এর মধ্য দিয়ে দলের মধ্যে সৃষ্ট অনৈক্য আপাতত ঐক্যে ফেরানো যাচ্ছে না। বরং অভ্যন্তরীণ তিক্ততা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে বলে মনে করেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
তবে বসিক নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনার কেন্দ্রীয় প্রধান সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, বরিশাল আওয়ামী লীগ এক ও অভিন্ন। যেটুকু দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা অচিরেই ঘুচে যাবে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে আমাদের কাজ থেমে নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল বসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর খায়ের আবদুল্লাহ ১৮ এপ্রিল বরিশালে আসেন। এর পর থেকে তিনি নানাভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। ফলে বরিশালের রাজনীতিতে তাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণ অনুসারী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক ও হাসানাত পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্যে ছিটকে পড়া পুরনো নেতাকর্মীরা খায়ের আবদুল্লাহকে সমর্থন দিয়ে মাঠে রয়েছেন।
জানা যায়, মহানগর আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রক বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। আর তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় জেলার নেতারাও সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে। ফলে আবুল খায়ের দলের নেতাদের সহযোগিতা ছাড়াই নির্বাচনী কার্যক্রমে মাঠে রয়েছেন। তার সঙ্গে আছেন দল থেকে ছিটকে পড়া নেতাকর্মীরা।
খোকনের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা সমর্থকরা মনে করছেন, সাদিক আবদুল্লাহ দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর রাজনীতি অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে। ফলে খুব সহজেই বিষয়টিকে মেনে নতুন প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠে শামিল হওয়াটা তাদের জন্য কঠিন। ফলে তারা নির্বাচনী মাঠে অংশ নিলেও দলের ভেতরে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, তা মøান হওয়ার নয়।
জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল মেয়র পদে আ.লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রদানের পর চুপ থাকা হাসানাত ও তার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহর মান ভাঙাতে চারদিন পর ১৯ এপ্রিল তাদের ঢাকার বাসায় হাজির হন মেয়রপ্রার্থী খোকন আবদুল্লাহ। এ সময় তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশাপাশি প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে। তারপর আর তাদের একসাথে দেখা যায়নি।
এদিকে, সকল মান-অভিমান ভেতরে চাপা দিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে শুক্রবার বর্ধিতসভায় মেয়রপ্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত অংশ না নেওয়ার পাশাপাশি হাসানাত আবদুল্লাহ ও তার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন, বিশেষ করে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ কমিটির অন্য নেতৃবৃন্দ এবং ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি দলীয় মেয়রপ্রার্থী। ফলে দলে ঐক্য ফেরা নিয়ে এখনো শঙ্কা কাটেনি।
দলীয় সূত্র জানায়, বসিকের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে দল মনোনয়ন দিয়েছে তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে। এতে ক্ষুব্ধ ও হতাশ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থকরা। ফলে গত ১৫ এপ্রিল দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকে খায়ের আবদুল্লাহর পাশে নেই জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পদধারী নেতারা। এমনকি ৩০টি ওয়ার্ডের নেতারাও সাদিক আবদুল্লাহর নির্দেশ ছাড়া নির্বাচনী কাজে অংশ নিচ্ছেন না।
খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, নির্বাচন সম্পন্নে ইতিমধ্যে নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি করে কমিটি করা হয়েছে। একইভাবে ১২৬টি ভোটকেন্দ্রের জন্য পৃথক কমিটি করা হয়ে গেছে। দলের পদে থাকা নেতাকর্মীরা নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত না হয়ে বরং ভাবলেশহীন আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় প্রার্থী তার সমর্থক নেতাদের নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন।
তারা আরও জানান, ৩০টি ওয়ার্ডে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা এবং ভোট কেন্দ্রের ১২৬টি কমিটিতে সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি।
তবে সকল গুজব উড়িয়ে দিয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, আমাদের নেতা (হাসানাত) শুক্রবার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা যে কোনো সময় নির্বাচনের মাঠে নামব। হাসানাত আবদুল্লাহ বিভাজনে নয়, দলের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করেছেন।
মো. ইউনুস আরও বলেন, খায়ের আবদুল্লাহ বর্ধিতসভায় কেন যাননি বলতে পারব না, তবে যাওয়া উচিত ছিল। কারও মধ্যে কোনো ক্ষোভ থাকলেও তিনি গেলে মিটে যেত।
নৌকা প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন মোহন বলেন, আমরা চাই না বরিশালের প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের মতো দুঃখজনক পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটুক। এজন্য আমরা আমাদের প্রার্থীকে সাবধানে পথচলার পরামর্শ দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আমাদের মুরব্বি। তার কৌশল ও পরামর্শ আমরা নির্বাচনী কাজে অবশ্যই ব্যবহার করব।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), বরিশাল মহানগর সাধারণ সম্পাদক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মো. রফিকুল আলম বলেন, যে কোনো কিছু অর্জন করতে ঐক্যের বিকল্প নেই। সেটা দেশের জন্য যুদ্ধ হোক কিংবা ভোটযুদ্ধ হোক। আওয়ামী লীগের ভেতরে চলা অনৈক্য যদি ঐক্যে ফেরাতে না পারে তা হলে নির্বাচনে নৌকা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে বলে তিনি মনে করেন।