রাজধানীর গুলশানে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাসভবন ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে’ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন এক নারী। তার ভাষ্য, অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তিন ব্যক্তি তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। গুলশান থানায় একাধিকবার গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। এ ঘটনায় এরশাদের স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক সম্পৃক্ত বলেও অভিযোগ তুলেছেন ওই নারী। তবে বিদিশা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কোনো গোষ্ঠী তাকে ফাঁসাতে এসব অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
অভিযোগ তোলা ওই নারী জানান, তিনি বিদিশাকে ব্যক্তিগত কাজে সহযোগিতা করতেন। প্রায় পাঁচ মাস তিনি প্রেসিডেন্ট পার্কে কাজ করেন।
গুলশান থানায় যাওয়ার ফুটেজ ও অভিযোগপত্রসহ বেশকিছু নথিপত্র ওই নারী আমাদের সময়কে দিয়েছেন। তিনি জানান, মামলা করতে না পেরে পুলিশ সদর দপ্তরের আইজিপি’স কমপ্লেইন সেলেও তিনি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
গুলশান থানার ওসি এবিএম ফরমান আলী গতকাল শনিবার বিকালে আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে’ দলবেঁধে মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায়ও আসেনি।
তবে অভিযুক্তদের একজন আমাদের সময়ের কাছে স্বীকার করেন, ভুক্তভোগী তরুণী অভিযোগ নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। প্রাপ্ত ভিডিও ও স্থিরচিত্রও বলছে, থানার চার পুলিশ সদস্যের সামনে এজাহারে স্বাক্ষর করেন ভুক্তভোগী।
আইজিপি’স কমপ্লেইন মনিটরিং সেলে লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী বলেছেন, “আমি যাত্রাবাড়ী থানাধীন ধলপুরে সপরিবারে থাকি। বিদিশা সিদ্দিকার ব্যক্তিগত কাজে সহযোগিতা করার জন্য প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রেসিডেন্ট পার্কে আমার যাতায়াতা ছিল। শুরুতে ভালোই ছিলাম। আমাকে মাসে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। আস্তে আস্তে আমি বুঝিতে পারি, প্রেসিডেন্ট পার্কে রাত ৮টা থেকে ৯টার পর বিভিন্ন অচেনা পুরুষের সমাগম হয়। বিদিশা সিদ্দিক, মোরশেদ মনজুর এবং অভিযুক্ত অজ্ঞাত দুজনসহ বিভিন্ন অজ্ঞাত লোকজন নিয়ে মদের পার্টি করতেন এবং বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যক্রম করতেন। আমি বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে যাই। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিদিশা আমাকে বলেন যে মোরশেদ মনজুর সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট পার্কে আসবে। আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টার দিকে মোরশেদ প্রেসিডেন্ট পার্কে আসেন। আমি তখন ছোট ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। এ সময় বিবাদীরা হঠাৎ বাসার সব সিসি ক্যামেরার সংযোগ খুলে ফেলে। একপর্যায়ে মোরশেদ মনজুরসহ অচেনা আরও দুই যুবক জোর করে আমার গায়ে হাত দেয়। আমি প্রতিবাদ করলে মোরশেদ আমাকে চড়থাপ্পড় মারে এবং টেনেহিচড়ে শোবার ঘরের দিকে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে ইসাবেলা লেখা বেডরুমে নিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে প্রথমে মোরশেদ আমাকে ধর্ষণ করে। এরপর অচেনা আরও দুজন আমাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পুরো দৃশ্য পাশে দাঁড়িয়ে বিদিশা সিদ্দিক তার স্যামসাং ফোনে ভিডিও করে রাখেন। একপর্যায়ে বিবাদীরা আমাকে মুখ বন্ধ করে রাখতে বলে এবং তারা যা বলবে তা করতে বলে প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে বের করে দেয়। আমি ভয় পেয়ে বাসায় চলে আসি এবং বাসা পাল্টে ফেলে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিই। গত ২৪ মার্চ আনুমানিক রাত ৯টার দিকে মোরশেদ মনজুর আমার টিকাটুলির বাসায় এসে আমাকে ভয় দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট পার্কে নিয়ে যায়। বিদিশা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন আমি তাদের সঙ্গে যোগযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। একপর্যায়ে বিদিশা তার হাতে থাকা মোবাইল ফোন থেকে আমাকে ধর্ষণের ধারণ করা ভিডিওটি দেখিয়ে বলে, ভিডিওটি আমার স্বামীকে দেখিয়ে আমার ৩ সন্তানসহ সংসার ভেঙে দেবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল করে দেবে। এরপর মোরশেদ মনজুর আগের সেই রুমে নিয়ে আমাকে ফের ধর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, বিদিশা অজ্ঞাত দুই বিবাদীকে ফোন করে ডেকে আনেন। তারা এসে আমাকে ফের ধর্ষণ করে। তারা আমাকে তাদের কথামতো চলতে হবে এবং হুমকি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে চলে যেতে বলে। পরবর্তী সময়ে বাসায় এসে আমি আমার স্বামী ও পরিবারকে জানাই। বিবাদীদের ভয়ে আমি ও আমার স্বামীসহ বাসা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। গত ১৩ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিদিশার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পার্কে মদের পার্টি, অপহরণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর আমি সাহস পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিই।”
অভিযোগে তরুণী আরও বলেন, “গণধর্ষণের বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল গুলশান থানায় মামলা করতে গেলে ওসি এবিএম ফরমান আলী আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং মামলা নেবে না বলে জানান। পরবর্তী সময়ে আমি গুলশান ডিসিকে বিষয়টি জানাই। তিনি ওসি ফরমান আলীকে ফোন করেন এবং আমাকে লিখিত অভিযোগ নিয়ে গুলশান থানার ওসি (তদন্ত) শাহীনুর রহমানের কাছে জমা দিতে বলেন। আমি শাহীনুর রহমানের কাছে আমার স্বাক্ষর করা অভিযোগপত্র জমা দিই। পুলিশ আমাকে পরের দিন থানায় দেখা করতে বলে। পরের দিন গুলশান থানায় গেলে থানা কর্তৃপক্ষ ঘটনা অস্বীকার করে। একপর্যায়ে থানায় শাহীনুর রহমান আমার ছবি তোলেন। আমার ছবি ও অভিযোগপত্রের কপি বিবাদী পক্ষকে দিয়ে দেয় এবং আমার থানায় আসার বিষয়টিও বিবাদীদের জানিয়ে দেয়। বিবাদীরা আমার ছবি ও এজাহার দেখিয়ে আমাকে বিভিন্ন রকম হুমকি প্রদান করে। এখন পর্যন্ত থানা মামলা গ্রহণ করেনি।”
ওই নারী জানান, গত ২৯ এপ্রিল রাত ৮টা ৩১ মিনিটে তার মোবাইল ফোনে একটি বার্তা (মেসেজ) আসে। এতে তরুণীর নাম উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, ‘তুমি কাজটা মোটেও ঠিক করোনি, যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি থানায় মামলা করতে গেছ, এত সাহস? বোকা মেয়ে, আমি প্রেসিডেন্টের বউ। থানা আমি নিয়ন্ত্রণ করি। এ জন্য মামলা নেয়নি, নেবেও না। ওই দিন ওসি ফরমান তোমাকে পিটাই তো, যদি আমি বলতাম। ফাস্ট টাইম দেখে ছেড়ে দিলাম তোমাকে। পরিবার ও বাচ্চা নিয়া চুপচাপ থাক। বাড়াবাড়ি করলে ফ্যামিলিসহ গায়েব করে দিব।’
একই সেলফোন থেকে পরে আরেকটি বার্তা আসে। তাতে লেখাÑ যে কয়জন থানায় গেছ, সবগুলাকে গায়েব করে দিব। কে কে থানায় গিয়েছিল, সবার তথ্য আমি পেয়ে গেছি। তোমাকে যেন আর কোনো দিন গুলশান থানার আশপাশে না দেখি।’
বিদিশা সিদ্দিক তার গ্রামীণফোন নম্বর থেকে এসব বার্তা পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ওই নারী। তবে অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বিদিশা সিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে কোনো গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। আমার বাসার ওই গৃহকর্মী অভিযোগ নিয়ে মামলা করতে গুলশান থানায়ও গিয়েছিল। কিন্তু তার অভিযোগের সত্যতা পায়নি পুলিশ। তাই হয়তো মামলা নেয়নি।’
হুমকি দিয়ে বার্তা পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অন্য কোনো মোবাইল ফোন থেকে তার মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে কোনো গোষ্ঠী হয়তো আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। কিছু ষড়যন্ত্রকারী আমার সম্মানহানি করতে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।’