চড়া বাজারে আদার দরের হঠাৎ উল্লম্ফনে বেকায়দায় ফেলেছে ভোক্তাদের। বর্তমানে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। এক মাস আগেও যে আদা ২০০ থেকে ২২০ টাকায় কেনা গেছে, তা এখন বেড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা হয়েছে। কোথাও কোথাও ৫০০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও উঠে এসেছে এক মাসের ব্যবধানে আদার দাম ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে ২০৯ দশমিক ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশি আদার দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এ হিসাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় এ মসলাপণ্যের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তার খরচের চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর দেশে আদার চাহিদা রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মে. টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ৮০ হাজার মে. টন। আর বাকি অংশের সিংহভাগই আমদানি হয় চীন থেকে। এ ছাড়া ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ থেকেও আদা আসে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, লম্বা সময় ধরে চীন থেকে আদার আমদানি কমেছে। কিন্তু সম্প্রতি চীনেই আদার উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশটি রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে চীনা আদার বুকিং রেট বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমিয়েছেন আমদানিকারকরাও। তা ছাড়া ডলার সংকট ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও রয়েছে।
রাজধানীর পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ মসলাজাতীয় পণ্যের বৃহত্তম বাজার শ্যামবাজারের বিক্রমপুর ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী মো. খোকন বলেন, বাজারে চীনা আদার সরবরাহ একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। দেশি আদার পাশাপাশি এখন যা পাওয়া যাচ্ছে তার বেশিরভাগ মিয়ানমার, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত। মূলত চীনা আদার সংকটেই বাজার গরম হয়ে উঠেছে। কারণ চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পূরণ হয় চীনা আদা দিয়ে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, চীনা আদার আমদানিতে খরচ অনেকখানি বাড়লেও অন্যান্য আদার ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক অনেক কম। তারা জানান, চীনা আদার সংকটের সুযোগ নিয়ে হাতবদলে দাম অতিরিক্ত বাড়ানো হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে যে আদা ১৭০ টাকায় কেনা, তা চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ আড়তে ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে এসে সেই আদার দাম বেড়ে হয়ে যাচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা। কোথাও কোথাও ৪০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে চীনা আদা দেশে আসতেই ৩০০ টাকার ওপরে খরচ পড়ছে। হাতবদলে এ আদা খুচরায় ৪৫০ টাকায় ঠেকেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। এতে খুচরায় আদার দাম ৫০০ টাকা পর্যন্তও পৌঁছেছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রকারভেদে আদা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। খুচরায় একমাস আগেও চীনা আদার কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা ছিল। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকা।
চাহিদার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে দেশে ২০ হাজার মে. টন আদার চাহিদা রয়েছে। কোরবানির ঈদের মৌসুমে এ চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীদের অনেকে মনে করছেন, এ সুযোগে আসছে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আদার দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে বড় অংকের মুনাফা করছে আদার সিন্ডিকেট চক্র।
রাজধানীর কদমতলী এলাকার সাদ্দাম মার্কেট বাজারের মিলন স্টোরের ব্যবসায়ী মিলন বলেন, পাইকারি বাজারে চীনা আদা এক প্রকার গায়েব। দাম কেবল বাড়ানো হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়তি হলেও দেশের বাজারে দাম বাড়ার চিত্র অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। চীনা আদার সংকট হলেও দেশি আদাসহ বার্মিজ, ভারতের ও অন্যান্য দেশের আদা অনেক রয়েছে। তার পরও আদার দাম অতিরিক্ত বাড়ানো হচ্ছে। আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখেও দাম বাড়ানো হতে পারে।
এ বাজারের একজন ক্রেতা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. কৌশিক আহমেদ বলেন, গত বছরেও ১০০ টাকার আশপাশে আদা কেনা গেছে। আজ (শুক্রবার) সেই আদাই কিনলাম ৪০০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ এক বছরে প্রতিকেজি আদার পেছনে ৩০০ টাকা খরচ বেড়ে গেছে। এটা তো অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। একটি পণ্যের পেছনে এত খরচ বাড়লে চলব কীভাবে?
টিসিবির তথ্যও বলছে, গত বছর এ সময় প্রতি কেজি আমদানিকৃত আদা (প্রকারভেদে) বিক্রি হয় ৯০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। শুক্রবার তা ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২০৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। অপরদিকে এক বছর আগে এ দিনে দেশি আদার কেজি বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১৪০ টাকা। গতকাল বিক্রি হয় ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা পর্যন্ত। বছরের ব্যবধানে এ আদার দাম বেড়েছে ১৭৫ শতাংশ।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বর্তমানে প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা নৈতিক ব্যবসা করছেন না। সুযোগ পেলেই অজুহাত দেখিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা রয়েছে। আদার ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে সমানুপাতিক হারে বেড়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। নজরদারি বাড়াতে হবে। কেউ অতিরিক্ত দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি সরবরাহ স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের কাছাকাছি রাখতে বিকল্প উৎস দেশগুলো থেকে আমদানি বাড়াতে হবে। সরবরাহ স্বাভাবিকের কাছাকাছি থাকলে দাম অতিরিক্ত বাড়তে পারবে না।