প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়রের মতো বড় পদে জয় পেয়েছেন জায়েদা খাতুন। স্থানীয়রা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ সাত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে জায়েদা খাতুনের এ জয়ে তার ছেলে ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তার বড় ধরনের প্রভাব আছে। আর নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পরাজয়ের পেছনে ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভাজন ও অতিআত্মবিশ^াস। এই বিভাজনের কারণে দলের তৃণমূলের একটি অংশ ভোটের দিন নৌকার ব্যাচ পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের পক্ষে কাজ করেন। বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় তাদের ভোটও টেবিল ঘড়ি প্রতীকের বাক্সে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
নৌকার অন্যতম নির্বাচনী পরিচালনাকারী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ ম-ল আমাদের সময়কে বলেন, ‘দলের অনেকেই সামনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন, গোপনে অবস্থান নিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর (জায়েদা খাতুন) পক্ষে। এ ছাড়া বিরোধী দলের ভোটও স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছেন। তবে পরাজয়ের মূল কারণ খুঁজতে আমরা তদন্ত করব।’
গত বৃহস্পতিবার ভোটের দিন সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের এজেন্ট ছিল না। নৌকা ও হাতপাখার এজেন্টই বেশি ছিল। খোদ আজমত উল্লার বাড়ির পাশের কেন্দ্রেও নৌকার ব্যাচ পরা একাধিক কর্মীকে বলতে শোনা যায়- ‘ঘড়ির বিষয়টা যেন মাথায় থাকে’ ‘প্রতীক কিন্তু ঘড়ি’।
এর কারণ হিসেবে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর সাব অনেকের উপকার করেছেন, অনেকে তাকে পছন্দ করেন। তাই তারা জায়েদাকে ভোট দিয়েছেন।’ সেখানে থাকা আরও কয়েকজন ভোটার একই মত পোষণ করেন।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) এ ভোটে তেমন কোনো সহিংসতা হয়নি। কারচুপির অভিযোগও তোলেননি কোনো প্রার্থী। মেয়রপ্রার্থী হিসেবে না থাকলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আলোচনায় ছিলেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। নিজে প্রার্থী হতে না পেরে তার মাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করে নির্বাচনের মাঠে আনেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নৌকা ও জায়েদা খাতুনের মধ্যে। তবে ভোটের মাঠে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের পক্ষে বড় কোনো শোডাউন দেখা না যায়নি। নগরজুড়ে জায়েদা খাতুনের তেমন পোস্টারও চোখে পড়েনি।
অভিযোগ রয়েছে, পোস্টার সাঁটানো হলেও পরমুহূর্তে তা ছিঁড়ে ফেলেন প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থকরা। হুমকি দেওয়ার কারণে অনেকে ভোটকেন্দ্রে এজেন্টই হতে পারেননি। প্রকাশ্যে প্রচারেও নামতে পারেননি সমর্থকরা। বাধার মুখে প্রার্থী নিজেও যেতে পারেনি সব জায়গায়। প্রচারকালে চারবার হামলা হয় তাদের ওপর। বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হন। এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে টেবিল ঘড়ির পক্ষে সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল।
এ ছাড়া জাহাঙ্গীর আলম মেয়র থাকাকালে অনেকের নানাভাবে উপকার করেন। জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন করে মহানগরের অনেক তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন তিনি। অনুদান দিতে মসজিদ-মাদ্রাসায়। তার এসব কর্মকা- কাজে লেগেছে মায়ের বিজয়ে।
এদিকে গাজীপুরে নৌকার পরাজয়ে অতিআত্মবিশ্বাস, দলীয় বিভাজন ও বিচ্ছিন্ন প্রচার বড় কারণ বলে ধারণা অনেকেরে।
জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরে আওয়ামী লীগে বিভাজন শুরু হয় প্রায় এক যুগ আগে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এ বিভাজন প্রশমিত করতে পারেনি কেন্দ্র। উল্টো একপক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করতেই ব্যস্ত থাকত অধিকাংশ সময়। এর রেশ পড়েছে এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় দল থেকে বহিষ্কার হন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এরপরও দলের অনেক কর্মী-সমর্থক তার সঙ্গেই ছিলেন। জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের পর এসব কর্মী-সমর্থককে পড়তে হয় ‘প্রতিহিংসার’ মুখে। শোকজ করা হয় দুই শতাধিক নেতাকে। পরবর্তী কমিটিতে জাহাঙ্গীর অনুসারী কারও আর স্থান হয়নি।
এমন অবস্থায় নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর দলের তৃণমূলের একটি অংশ ‘নীরবে’ জাহাঙ্গীরের পক্ষে চলে যায়। অনেকে ভোটের দিন নৌকার ব্যাচ পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের পক্ষে কাজ করেন। এর আগে এমন অভিযোগে নির্বাচনী প্রচারের সময়ও দলের তিনজন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়; শোকজ করা হয় আট নেতাকর্মীকে। এ ছাড়া পুলিশ দিয়ে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করারও অভিযোগও আছে। নির্বাচনের দিন সব কেন্দ্রে নৌকার কর্মীদের আধিক্য থাকলেও দিনশেষে জয়ী হয় জায়েদা খাতুনের ঘড়ি।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অতিআত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তাদের প্রচারে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। মহানগরের স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাজে না লাগিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের নিয়ে আসা হয় নির্বাচনী প্রচার কাজে। নৌকার কর্মী-সমর্থকরা নিশ্চিত ছিলেন, শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে যাবেন; কিন্তু ছাড়েননি। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থকদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা, বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে হঠাৎ করে পুলিশের অভিযানের ঘটনা ছিল প্রতিনিয়ত। ভোটারদের একটা হুমকিতে রাখার চেষ্টা হয়েছে। এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে নৌকার প্রার্থীর বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, একাই নানা পথসভায় বক্তব্য দিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। তিনি সব জায়গায় জাহাঙ্গীরের দুর্নীতি নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে গেছেন। সরকারের নেওয়া নানা উন্নয়ন প্রকল্প তিনি ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে পারেননি।
ভোটাররা বলছেন, আজমত উল্লার এলাকা টঙ্গীতে প্রবেশের সময় জায়েদা খাতুন বারবার বাধার মুখে পড়েন। তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, কর্মীদের মারধর করা হয়। এসব বিষয়ও নৌকার বিপক্ষে গেছে।