অসচ্ছল মুসল্লিদের প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাওয়ার সুযোগ দেয় সরকার। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, মসজিদের ইমামসহ ২৫০ থেকে ৩০০ ব্যক্তি হজে যেতেন। তবে হজের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাওয়ার লাগাম টেনেছে সরকার। পাঁচ হাজারের বেশি আবেদন থেকে ২৩ জনকে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তবে হজে ব্যয়সংকোচনের বালাই নেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। হজযাত্রীদের সেবাদানের নামে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলে ঢুকে পড়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি দপ্তরের বাবুর্চি, অর্ডালি, জমাদার ও ফটোকপি অপারেটরও। তালিকায় আছেন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, গানম্যান ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীও। সরকারি নিয়মানুযায়ী, সহায়তাকারী দলের সদস্যদের হজ করার কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে একাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, সহায়তাকারী দলের সদস্যদের হজ করার কোনো সুযোগ নেই। শর্ত অনুযায়ী, তারা শুধু হজযাত্রীদের খেদমতে নিয়োজিত থাকবেন। সৌদি আরবে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু তারা সবাই সহায়তাকারী সেজে হজ পালন করার উদ্দেশ্যেই সৌদি আরব যাচ্ছেন। প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলের সদস্য হিসেবে মোট ২০৩ জন সৌদি আরব যাচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগই নিজ নিজ দপ্তর থেকে ছুটি নিয়েছেন ‘হজ করতে’ সৌদি আরব যাওয়ার কারণ দেখিয়ে।
এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘এসব কর্মচারী যাচ্ছে মানুষের (হজযাত্রীদের) লাগেজ ওঠানামা করার জন্য। হজযাত্রীদের সহযোগিতার জন্য। কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের সময়ই বলে দেওয়া হয়েছে, তারা হজ করবে না। তবে একটি ওমরাহ করতে পারবে। এ জন্য তারা এহরাম পরে যাবে। তাদের হজের অনুমতিও নেই। বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করবে তারা।’
রাজশাহীর পবা উপজেলার মাসকাটাদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। হজ প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলের সদস্য তিনি। ১৯ মে থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। ঢাকায় আশকোনা হজক্যাম্পে অবস্থানকালে কথা হয় আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। প্রথমে তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী হজে যাচ্ছি। এখন আমরা আশকোনা হজক্যাম্পে অবস্থান করছি।’ কীভাবে প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলের সদস্য হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমার ছোটবোনের স্বামী যুগ্ম সচিব সাইফুল ইসলাম। সাইফুল বর্তমানে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অফিসের পরিচালক। সে আমার নামটি সহায়তাকারীর দলের তালিকায় ঢুুকিয়েছে। কিছু জানার থাকে সাইফুলকে ফোন করেন।’
ধর্ম মন্ত্রণালয়ে গঠিত হজ প্রশাসনিক দলেও আছেন সাইফুল ইসলাম। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার বেশ কয়েকবার অফিসের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) সাইফুল ইসলামকে ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো বারই ফোন ধরেননি। ফোনে লিখিত বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
এদিকে আবদুর রাজ্জাকের সৌদি আরব যাওয়ার বিষয়ে অবগত নন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। আবদুর রাজ্জাকের ছুটির খবরও আমার কাছে নেই।’
তবে পবা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হজে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেই আবদুর রাজ্জাক ছুটি নিয়েছেন।’
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসনিক সহায়তা টিমে আছেন ৭২ জন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তর ও সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসনিক সহায়তাকারী টিমে আছেন ৭৯ জন। এ ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ-১ শাখার উপসচিব আবু কাশেম মুহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে গত ১৪ মে। সেই তালিকায় আছেন ৫২ জন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- গণপূর্ত অধিদপ্তরের কেয়ারটেকার হাসান, ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর বাসার গাড়িচালক বাহার মিয়া, জামালপুরের দেওয়ান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাবুর্চি শুক্কুর আলী, সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুর রশিদ-১, সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারির ব্যক্তিগত সহকারী সেলিম মিয়াজি, ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুশফিকুর রহমান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর অফিস সহায়ক আলী আজিম, জামালপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার কামরুল ইসলাম, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী আবদুল জলিল ও স্বাস্থ্য সহকারী ইমরান খান, ইসলামপুর উপজেলার গাইবান্ধা ইউনিয়নের পরিবার-পরিকল্পনা পরিদর্শক আসাদুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের গাড়িচালক আবদুল মজিদ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিবহনপুলের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন, হুইপ পঞ্চানন বিশ^াসের জমাদার কামাল গাজী।
৭২ জনের তালিকায় আছেন- ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ফটোকপি অপারেটর তুহিন মিয়া, ডেসপাচ রাইডার হাবিবুর রহমান, অফিস সহায়ক অহেদুল ইসলাম মোল্লা, মমিন আলী ও রোকেয়া আক্তার, জমাদার জাকিরুল, অর্ডালী মুছা মিয়া, বাবুর্চি গোলাপী, প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের অফিস সহায়ক আশরাফুল আলম ও মহিবুর রহমান সেলিম, সমন্বয় শাখার অফিস সহায়ক সুমাইয়া আক্তার, অতিরিক্ত সচিবের (হজ) অফিস সহায়ক ইকবাল হোসেন মোল্লা, সচিবের দপ্তরের অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেন ও সাদ্দাম বিশ^াস, প্রশাসন-১ শাখার অফিস সহায়ক কামরুল ইসলাম, হজ-১ শাখার অফিস সহায়ক ইলিয়াস আহমেদ, উপসচিবের (হজ অধিশাখা) অফিস সহায়ক কাজী জুয়েল মিয়া, হজ-২ শাখার অফিস সহায়ক নাজমুল হক, সংস্থা-১ শাখার অফিস সহায়ক পারুলী আক্তার, ওমরাহ শাখার অফিস সহায়ক আলমগীর হোসেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গাড়িচালক টিটু মিয়া বেপারি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, জাকির হোসেন, শাহ মাজেদুর রহমান, মাহমুদ মিয়া, আবু তাহের, প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের গাড়িচালক মিনারুল ইসলাম, প্রতিমন্ত্রীর গানম্যান এসআই ফরিদুল ইসলাম, ধর্মসচিবের গানম্যান কনস্টেবল মাহফুজুর রহমান, হজ অফিসের গাড়িচালক সালাহউদ্দিন, অফিস সহায়ক হাবিবুর রহমান, বার্তাবাহক রফিকুল ইসলাম মোল্লা, দপ্তরি জালাল আহমেদ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. মোস্তফা ও রাজবাড়ী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিস সহায়ক খোরশেদ আলম।
৭৯ জনের তালিকায় আছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিস সহায়ক আবদুল জব্বার গাজী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর গাড়িচালক স্বপন মিয়া, গণপূর্ত অধিদপ্তরের গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের প্লাম্বার শফি আলী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ফটোকপি অপারেটর আইনুল হক, অফিস সহায়ক হারুনুর রশিদ ও আল আমিন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের অফিস সহায়ক লাইজু আক্তার, রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী মতিউর রহমান, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের রেকর্ড কিপার শাকিব হোসেন, টাঙ্গাইলের জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের অফিস সহায়ক তাজুল ইসলাম. জামালপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিস সহকারী ইয়াকুব আলী, ঢাকা ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের অফিস সহায়ক আবুল কাশেম, দিনাজপুরের বিরল উপজেলার দামাইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাজরিন আক্তার, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী জামাল উদ্দিন, হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরের সশস্ত্র নিরাপত্তাপ্রহরী মনির হোসেন, উপজেলা পরিষদের অফিস সহায়ক তোফাজ্জল ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের ফটোকপি অপারেটর উজ্জল, মাউশির সহকারী অধ্যাপক নোয়াব হোসেন, ঢাকা হজ অফিস মসজিদের মুয়াজ্জিন রুহুল আমিন।
সহায়তাকারী দলের সদস্য রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী মতিউর রহমান গত শুক্রবার বিকালে মুঠোফোনে আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি এখন বিমানবন্দরে আছি। কিছুক্ষণ পর ফ্লাইট। ডিপার্টমেন্ট থেকেই আমার নাম দেওয়া হয়েছিল। তাই হজ করার সুযোগ পেয়েছি।’
সহায়তাকারী দলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা সবাই বলেছেন, ‘সরকারি কোটায় হজের সুযোগ পেয়েছেন। তারা হজ করতেই সৌদি আরব যাচ্ছেন।’
সহায়তাকারী দলের সদস্য নৈশপ্রহরী জামাল উদ্দিনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাতিজপুর উপজেলায়। এ বিষয়ে সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হুসাইন বলেন, ‘সরকারি কোটায় তিনি হজে যাচ্ছেন।’ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের ফটোকপি অপারেটর উজ্জলের সৌদি আরব যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউএনও মুনিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সে হজ করতেই সৌদি আরব যাচ্ছে।’ তবে জামালপুর স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারীর সৌদি আরব গমন সম্পর্কে সিভিল সার্জন প্রণয় কান্তি দাস বলেন, ‘তারা সরকারি নির্দেশে হজযাত্রীদের সেবাপ্রদানের জন্য যাচ্ছে। সেখানে তারা হজ করার কথা নয়।’