ঢাকা ওয়াসায় বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়েছে। গত বুধবার স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এমডির বিরুদ্ধে চিঠি দিয়েছেন বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বলছেন, ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই মূলত ওয়াসার এই দুই কর্মকর্তা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। আর তাদের দ্বন্দ্বের কারণে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন ওয়াসার কর্মীরা।
এমডির বিরুদ্ধে খোদ বোর্ড চেয়ারম্যানের অভিযোগ তোলায় ওয়াসার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেছেন, ‘এটা নিজেদের মধ্যকার বিষয় না। প্রকৃতপক্ষে ঢাকা ওয়াসা একটা স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কর্তৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হয়েছে। এতদিন ওয়াসার দুর্নীতি নিয়ে টিআইবিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যম যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তারই বহির্প্রকাশ ঘটেছে ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যানের বক্তব্যে। এখন যেহেতু খোদ ওয়াসা বোর্ডের কাছ থেকে
দুর্নীতির অভিযোগগুলো এসেছে, এটাকে অবজ্ঞা করার উপায় নেই। কাজেই এ অবস্থার জন্য যিনি বা যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর ওয়াসায় যোগ দেন তাকসিম এ খান। এরপর পাঁচবার তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। শুরুতে তার সঙ্গে গোলাম মোস্তফার বোঝাপড়া ভালোই ছিল। এরপর আট বছর ওয়াসা বোর্ডে ছিলেন না গোলাম মোস্তফা। পুনরায় ২০২০ সালে ফিরে এমডির ‘উল্টো আচরণ’ দেখেন বলে অভিযোগ তার।
বোর্ডকে পাশ কাটানোর প্রবণতা থেকেই দ্বন্দ্ব শুরু হয় উল্লেখ করে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আট বছর পর যখন এলাম তখন তিনি (এমডি) আমাকে বোঝাতে চান, বোর্ড সদস্যদের কোনো কথা শোনার দরকার নেই। তাদের বেশি বলতেও দেবেন না। আপনি (গোলাম মোস্তফা) শুধু সিদ্ধান্ত দেবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে- এ কথা বলেই ওয়াসা এমডি বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে যেতেন বলে অভিযোগ চেয়ারম্যানের।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি সঠিক নয় জানিয়ে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘তার কাজ আর আমার কাজ এক নয়। সে প্রশাসন দেখবে। আর বোর্ড হচ্ছে নীতিনির্ধারণী ফোরাম। বোর্ড তার কর্মকা- দেখবে। বোর্ড যেসব সিদ্ধান্ত নেবে, সে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সে চায় না চেয়ারম্যান অফিসে যাক। চেয়ারম্যান অফিসে গেলে অনেক কিছু জেনে ফেলবে, এই কারণে সে আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।’
ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের পরেই এমডির অবস্থান। কিন্তু ওয়াসার সব সিদ্ধান্ত এমডি দেন বলে অভিযোগ গোলাম মোস্তফার।
ওয়াসা আইন (১৯৯৬) অনুযায়ী, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার বোর্ডসভা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমডি সেটিরও তোয়াক্কা করেন না বলে অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, যখনই এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন বা কথা বলেছেন, তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। হয় বরখাস্ত, না হয় তাকে পদানতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ঠিকাদার নিয়োগ ও কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রেও এমডির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বোর্ড চেয়ারম্যান।
প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা সম্প্রতি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এমডি সবসময় বোর্ডকে অবমাননা করেন। বোর্ডকে কাজ করতে দেন না। বোর্ডের কোনো সিদ্ধান্ত মানেন না। এসব বিষয়ে অভিযোগ করেছি মন্ত্রণালয়ে।’ বোর্ডসভায় এসব বিষয় কি কখনো তুলেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘কতবার বলেছি, কত ঝগড়া করেছি, কাজ হয় না।’
চিঠির পর কোনো সমাধান প্রত্যাশা করেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা আমার জানার বিষয় নয়। আমার যেটা দায়িত্ব মনে করেছি, সেটা বলেছি।’
চিঠির বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্রাহিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘চিঠিটা আমার কাছে এখনো আসেনি। বিষয়টি আমার নলেজেও নেই। পত্রিকায় দেখলাম অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছে। চিঠিটা পেলে দেখব ব্যবস্থার জন্য চিঠি লিখেছেন কিনা, আগে চিঠি আসুক।’
অভিযোগের বিষয়ে তাকসিম এ খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ বিষয়ে নো কমেন্টস। মন্তব্য নিষ্প্র্রয়োজন। আমি কোনো বক্তব্য দেব না, আমি কোনো মন্তব্য করব না। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নাই।’
ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি মো. আনিসুজ্জামান শাহীন খানের অভিযোগ, এমডির বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে বাধ্যতামলূক অবসরে পাঠানো হয়। আমাদের সময়কে শাহীন খান বলেন, ‘আমি তাকে (এমডি) জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও আপনি আমাকে যোগদান করতে দিচ্ছেন না কেন? জবাবে তিনি বলেন ‘অ্যাপ্লাই ইউর কমনসেন্স, আই হ্যাভ পাওয়ার।’ এই যদি হয় এমডির ভাষা, তাহলে কথা বলব কার কাছে?’
চিঠিতে ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন, ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সত্য কথা বলায় এমডি তার অনুগতদের দিয়ে চেয়ারম্যানকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমডি বর্তমানে আউট সোর্সিংয়ের নামে লঙ্কাকা- চালাচ্ছেন। এমডির আশপাশের লোকেরা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে জনবল সংগ্রহ করে কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে পোস্টিং দিচ্ছে। এসব লুটপাট কমানো গেলে ঘন ঘন পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। এসব নিয়ে বোর্ডে আলোচনা করতেও এমডি আগ্রহী হন না। বোর্ডের বৈঠক করতেও তিনি বাধা দেন।
মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের ওয়াসা বোর্ডের সঙ্গে অসহযোগিতা, ওয়াসা আইন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসা প্রশাসন পরিচালনা, ঢাকা ওয়াসাকে অনিয়ম, অপচয় আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ও ওয়াসা বোর্ডকে অবমাননা করার বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে চলে এলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতিতে বোর্ডের করণীয় সম্পর্কে আপনার দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করছি।’
এদিকে ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি মো. আনিসুজ্জামান শাহীন খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, গত ১১ মে কয়েকজন বিতর্কিত প্রকৌশলী ও দুজন পাম্পচালক সিবিএর নাম ভাঙিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। পত্রের বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।