পেঁয়াজে সিন্ডিকেটের প্যাঁচ

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

পেঁয়াজের মৌসুমে সরবরাহ সংকটের অজুহাত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়লেও শুধু ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধের দোহাই দিয়ে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ টাকা। এখন এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকায়। গত সপ্তাহে কেনা গেছে ৭০ টাকায়। এক মাস আগে যা ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়েছে দাম। প্রতিদিনের রান্নায় ব্যবহৃত পেঁয়াজের পেছনে খরচ হঠাৎ দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন সীমিত ও স্বল্পআয়ের মানুষেরা।

রাজধানীতে পেঁয়াজের বৃহত্তম পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহও পর্যাপ্ত নেই। তাই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। তারা বলছেনÑ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি মিললেই দাম কমে আসবে। এর আগে দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

আজমীর ভাণ্ডারের তপু সেনসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী জানান, শ্যামবাজারে পাইকারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত। কয়েক দিন আগেও বিক্রি হয় ৫৭ থেকে ৬০ টাকায়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকা এবং রোজার ঈদের সময়ে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৩৪ টাকায়।

শ্যামবাজারসহ কারওয়ানবাজারের বেশ কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের এমন সময় দেশি পেঁয়াজের সরবরাহে টান পড়ার কথা নয়। দামও বাড়ার কথা নয়। এখানে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে।

শ্যামবাজারের মিতালী আড়তের পাইকারি বিক্রেতা কানাই সাহা বলেন, বাজারে পেঁয়াজ আছে। দেশি পেঁয়াজের এখন মৌসুম। কৃষকরাও দাম পাচ্ছেন। এ সময় দেশি পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে অনেকটা সময় ধরে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় অনেকে সুযোগ নিচ্ছেন। বিভিন্ন জেলার মোকামেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে, যা রাজধানীতে এসে আরও বেড়ে যাচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৫ মার্চ থেকে হিলি স্থলবন্দরসহ সব বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে- এমন কারণ দেখিয়ে কিছু ব্যবসায়ী মজুদকৃত দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে বেশি মুনাফা করছেন।

পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরাতেও। রাজধানীর মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানা বলেন, ঈদের পর থেকে পাইকারি বাজারে কদিন পর পর দাম বাড়ছে। তাই আমাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে। দেশি পেঁয়াজের কেজি এখন বিক্রি করছি ৮০ টাকা। এ পেঁয়াজ ৭৪ টাকায় কেনা পড়েছে। কয়েক দিন আগেও যা ৬৫ টাকায় কিনেছি। তখন বিক্রি করেছি ৭০ টাকা। এই অল্পসময়ে পাইকারিতে প্রায় ১০ টাকা দাম বেড়ে গেছে।

মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই দিশাহারা অটোচালক মো. কাশেম মোল্লা। প্রতিদিনের আয়ের সীমিত টাকায় সংসারের বাজার খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে পেঁয়াজের মতো দরকারি পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। কদমতলী এলাকার এ বাসিন্দা বলেন, অন্যকিছু বাদ দেওয়া গেলেও পেঁয়াজ ছাড়া কি আর রান্না হয়। আর সে পেঁয়াজের পেছনেই খরচ এক মাসে দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। বাজারে ঠিকঠাক নজরদারি থাকলে এমন হতো না।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার পর্যবেক্ষণেও পেঁয়াজের দাম বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, গতকাল রাজধানীর বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। গত মাসে একই তারিখে যা ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে দেশি পেঁয়াজের দাম ১২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।

দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ায় আমদানি-নির্ভরতা আগের চেয়ে অনেকখানি কমেছে। এর পরেও হঠাৎ হঠাৎ বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে কিছু ব্যবসায়ী অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, কেবল পেঁঁয়াজ নয়, প্রায় সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই অনেক ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নানা অজুহাতে তারা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সরবরাহে নজরদারি কড়াকড়ি করলে এটা হতে পারে না। কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে বা কারসাজি করলে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

এদিকে পেঁয়াজের দাম শিগগিরই না কমলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সরকার। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, পেঁয়াজ আমদানিতে কোনো বাধা নেই। কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানির অনুমতি দেয়। তারা এত দিন ধরে সেটি বন্ধ রেখেছিল। এ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো বাধা নেই। তিনি জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় চেয়েছিল দেশের কৃষকরা যেন ন্যায্য দাম পান। তবে পেঁয়াজের দাম যদি দ্রুত না কমে সে ক্ষেত্রে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়ে দেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *