নির্বাচন সামনে রেখে কী হবে এখনই বলতে পারছি না

Slider রাজনীতি

রাশেদ খান মেনন। মুক্তিযুদ্ধের অনতম সংগঠক, দেশের বাম রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা। অতীতে বাম ঐক্যের প্ল্যাটফরম গড়তেও দেখা গেছে তাকে। অনেকে তাকে বামধারার সংশোধনবাদী নেতা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া এই রাজনীতিক ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে আসেন। কারাবরণ করেন বারবার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হন।

এমএ পরীক্ষা দেন জেলখানা থেকে। সে সময়ের প্রধান ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন মেনন। ছিলেন ডাকসুর ভিপি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ’৭৫পরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি জাতীয় সংকটে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে। পাঁচবার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। হয়েছেন মন্ত্রীও। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। এখন পর্যন্ত তার বইয়ের সংখ্যা ৯।

প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের আশিতম জন্মদিন আজ বৃহস্পতিবার (১৮ মে)। জন্মদিনকে সামনে রেখে গত মঙ্গলবার রাশেদ খান মেননের সঙ্গে কথা বলেন দৈনিক আমাদের সময়ের এই প্রতিবেদক। ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই কথোপকথনে তার ব্যক্তিগত বিষয়, আগামী দিনের নির্বাচন ও ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতিসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে।

রাশেদ খান মেননের কাছে শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু নিয়ে। জবাবে তিনি বলেন, ইতোপূর্বে ২০১৪ সালে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। সেবারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিএনপি তখনো নির্বাচনে আসেনি। এবার নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন বলে পত্রিকায় পড়েছি তাতে তিনি বলেছেন, যারা পার্লামেন্টে আছেন চাইলে নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে পারবেন। সর্বোপরি এবার নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হবে তা আমার জানা নেই; এটা আলোচনার বিষয়।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেনন বলেন, ইতোমধ্যে আমরা বলেছি চৌদ্দ দলের মাধ্যমে অর্থাৎ জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেব। তবে নির্বাচন সামনে রেখে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে এটা এখনো বলতে পারছি না।

জোটে থাকলেও দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে আসছেন। বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাদের নির্বাচনে আনার বিষয়ে আপনাদের প্রস্তাব থাকবে কিনা? জবাবে তিনি মেনন, বিএনপি একটি বড় দল। আমার প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন নির্বাচনে অংশ নেবে না? আমি এর কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। এর আগেও তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, এই সরকারের অধীনেই নিয়েছে। সুতরাং এবারের নির্বাচনে তারা অংশ নেবে বলে আমরা আশা রাখি।

বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে থাকার বিষয়ে আলোচনা করছে। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে পরোক্ষভাবে তো আপনারাও এই জোটের সঙ্গী হবেন। সেক্ষেত্রে আপনাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তি থাকবে কিনা? এ বিষয়ে মেনন বলেন, আমরা চৌদ্দ দলের সঙ্গে আছি। এর বাইরেও জোট হলে আমাদের আপত্তি নেই। এর আগেও তো আমরা মহাজোট করেছি। আপনারা শরিক দল হিসেবে এবার কতগুলো আসন চাওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিগত দিনের চেয়ে এবার বেশি চাইব।

ক্ষমতাসীন চৌদ্দ দলের অবস্থা কী? আপনাদের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সমন্বয় ঠিকমতো হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, চৌদ্দ দল যেভাবে সক্রিয় থাকার কথা ছিল কার্যতভাবে সেভাবে দাঁড়ায়নি। সক্রিয় না। বিভিন্ন দিবসভিত্তিক আলোচনার মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ। তবে চৌদ্দ দলের একটি পারস্পরিক যোগাযোগ তো আছেই। কিন্তু এর কার্যত ভূমিকা আগের মতো নেই।

আপনাদের দলের পঞ্চাশ বছরপূর্তি চলছে। বছর ধরে নানা আয়োজিন ছিল। বুধবার এটার সমাপনী আয়োজন। পঞ্চাশ বছরে আপনাদের প্রাপ্তি কী? এর জবাবে মেনন বলেন, নতুন সমাজের অভিযাত্রায় আমরা এগোব। সেই অনুযায়ী বুধবার পথনির্দেশনা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা এই পঞ্চাশ বছরে ক্রোধ, বিভক্তি নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছি। ফলে পঞ্চাশ বছরে দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূলধারাকে অগ্রসরমাণ করতে পেরেছি বলে আমরা মনে করি না। কিন্তু দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা মানুষের অধিকার আদায়ে অংশ নিয়েছি। আওয়ামী লীগের সময়েও আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আবার খুনি মোশতাকের ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েও কথা বলেছি। পরবর্তী সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনে ছিলাম।

অনেকে বলেন, আপনাদের দল প্রতিষ্ঠার যে উদ্দেশ্য ছিল তা থেকে আপনার সরে গেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ায় দলীয় আদর্শের বৈপরীত্ব দেখেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপাতি বলেন, না, আমরা সরে যাইনি। ঐক্য করা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তা হলে সেটা ভিন্ন কথা। সারাবিশ্বে ঐক্য হচ্ছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কি ঐক্য করে না? করেছে। কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য করেছে। কংগ্রেসের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকার পরও তারা ঐক্য করেছে। ঐক্য করা একটা সাধারণ নীতি। ঐক্য করা মানে নিজের দলকে বিলীন করে দেওয়া নয়।

ঐক্য তো সিপিবি বা অন্যান্য বাম দলের সঙ্গেও হতে পারত। এ প্রসঙ্গ টানতেই তিনি বলেন, সিপিবি তো চৌদ্দ দলে ছিল। পরে তারা চলে গেছে।

আপনার ব্যক্তিগত প্রশ্নে আসি। ১৮ মে আপনার আশিতম জন্মদিন। আপনি যৌবনে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ডাকসুর ভিপি ছিলেন। ’৬২র শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনসহ বাম রাজনীতি করেছেন। আছেন আজও। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কি কোনো দ্বিচারিতা আছে? একটু কঠিন হয়ে গেল প্রশ্নটা? এর জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘প্রশ্নটা কঠিন নয়। দ্বিচারিতা হবে কেন? দ্বিচারিতা নেই। আমি একটা আদর্শ অনুসরণ করে এগিয়েছি। আদর্শ লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে তা হলে কোনো কিছুতেই তা বাধাগ্রস্ত হয় না। প্রাপ্তির প্রসঙ্গ যদি বলেন, জীবনে অনেক পেয়েছি। আবার অনেক কিছু পাইনি। মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় ঘটনা মানুষের জীবনে আসে না। হাজার বছরেও আসে না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। পরবর্তীকালে দেড় দশকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। সেই লড়াইয়ের রচয়িতার মধ্যে আমি একজন। সুতরাং সব মিলে অনেক অর্জনই আছে। আবার এটা ঠিক, যা করতে চেয়েছি তা করতে পারিনি।

এ প্রসঙ্গে মেনন বলেন, যেমন- একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ছিল নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই উল্টোপথে হাঁটা শুরু করল। ফলে লড়াইটা আমাদের আবার করতে হলো। আবার ২০০৮ সালে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই লক্ষ্যে প্রত্যাবর্তন করলাম। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সমঝোতার রাজনীতি আমরা লক্ষ করি তাতে তারাই বেশি লাভবান হয়েছে। যে সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য লড়াই করেছি আমরা, সে সমাজে বৈষম্য আরও প্রচ-ভাবে বেড়ে গেছে। এটা ঠিকঠাক স্বীকারও করা হচ্ছে না। ফলে জীবনে এসব অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে।

আপনার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘একজীবন : স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ বাতিঘর থেকে প্রকাশ হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ কতদূর এগোল? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, লিখছি। একটু সময় নিয়ে লিখতে হচ্ছে। যাতে কোনো ভুল না থাকে তা বিবেচনা করেই লিখছি। আমাদের দেশের সমস্যা হচ্ছে যে, প্রপার ডকুমেন্টেশন আমাদের দেশে নাই। যার ফলে স্মৃতি থেকে ধারণ করে এগোতে হয়। আস্তেধীরে এগোচ্ছি।

আত্মজীবনী লেখার চ্যালেঞ্জ আছে কিনা? অনেকে বলে থাকেন যে, আত্মজীবনীতে অর্ধেক জীবন লেখা হয়…। এই প্রশ্নে মেনন বলেন, অর্ধেক জীবন কেন হবে? হয়তো সব কথা বলা হয় না। মূল কথাগুলো তো বলতে পারেন। চ্যালেঞ্জ একটাই, লেখক কতটা সৎভাবে কথাগুলো বলেছেন।

আপনার ঘটনাবহুল জীবনের এই পর্যায়ে রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিককর্মী ও পত্রিকার পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলুন। এমন প্রশ্নে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান বলেন, আমার বক্তব্য একটাই। যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম- সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ, বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার মাধ্যমে অগ্রসরমাণ বাংলাদেশ, উন্নয়নশীল বাংলাদেশ সেটা যাতে প্রতিষ্ঠা হয়, সে লক্ষ্যে সবাই কাজ করবে বলে আমি আশা রাখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *