পাকিস্তানকে এখন আর সভ্য দেশ বলা চলে কিনা ভেবে দেখতে হচ্ছে। কারণ সেখানে দেশ শাসন আর অসভ্যতা দৃশ্যত এক হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন সরকার সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ শুধু অমান্য করেছে তাই নয়, আদালতের ওপর চড়াও হয়েছে। সরকারি দলের নেত্রী মরিয়ম নওয়াজ আদালতের অঙ্গনে ঢুকে বিক্ষোভ করেছেন। আর সরকারের শরিক দলের নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের রেড অ্যালার্ট জোনের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। ১৪ মে মরিয়ম ও মাওলানার এই কর্মকাণ্ডের দিনটি ছিল নির্বাচন করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিত দিন। সরকার সে নির্দেশ মানেনি। নির্বাচন করেনি, নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা দেয়নি। উল্টো কোর্টের ওপর চড়াও হয়েছে। এ সবই আইন ও সংবিধানের চরম লঙ্ঘন।
আদালত প্রাঙ্গণের বিক্ষোভে মুসলিম লীগের (নওয়াজ) নেতা মরিয়ম নওয়াজ পাকিস্তানের বর্তমান বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়ালকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, বিচার বিভাগ দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের পক্ষ নিয়েছে। গত ৯ এপ্রিল ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আর সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খানের গ্রেফতার অবৈধ ঘোষণা করে তাকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। একদিন পর তাকে দুই সপ্তাহের জামিন দেন ইসলামাবাদ হাইকোর্ট।
এই প্রধান বিচারপতিই কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্যরাতের প্রক্রিয়া ঠিক ছিল বলে রায় দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হন। আর তখন থেকেই রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এই মুহূর্তে গুরুতর রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে পাকিস্তান। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, দেশটি আবারও বড় ভাঙনের মুখে পড়ে কিনা এমন জল্পনাও চলছে কোথাও কোথাও।
পাকিস্তানের রাজনীতি কখনোই স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ গতিতে চলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৭৬ বছরে কোনো একটি রাজনৈতিক সরকারও তার ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদ পুরো করতে পারেনি। দেশটির সেনাবাহিনী সব সময়ই রাজনীতিতে হাত বাড়িয়েছে এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের ঊর্ধ্বে থেকে রাজনীতিকদের ওপর জবরদস্তি ছড়ি ঘুরিয়েছে। অথচ সেনাবাহিনী ও সেনা শাসকরা যে কখনোই দেশ পরিচালনায় সাফল্যের পরিচয় দেননি তার প্রমাণ বেশুমার। সারা দেশকে বঞ্চিত করে বাজেটের বিপুল অর্থ সেনা সংস্থাপনার পেছনে ব্যয় করা হলেও কোনো একটি যুদ্ধেও তারা কখনোই জয়ী হননি। সবচেয়ে বড় প্রমাণ, দেশের অখণ্ডতা রক্ষায়ও তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। জলজ্যান্ত উদাহরণ ১৯৭১।
এই মুহূর্তে পাকিস্তানের পরিস্থিতি যেভাবে সঙ্ঘাতের দিকে মোড় নিচ্ছে সেটি ১৯৭১-এর স্মৃতি জাগিয়ে দিচ্ছে অনেকের মনে। মোটা দাগে ঘটনা তো সেই একই। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ও তার নেতাকে ক্ষমতার বাইরে ঠেলে দেয়া। ১৯৭১-এ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে টার্গেট করা হয়েছিল; এখন ইমরান খান ও তার দল তেহরিক ই ইনসাফ পার্টিকে (পিটিআই)। মূল ভূমিকায় সেই একই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কারণটাও এক। কায়েমি স্বার্থ। এখনকার পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ কায়েমি স্বার্থের সাথে যোগ হয়েছে বহু বছর ধরে মোড়লিপনায় অভ্যস্ত বহিঃশক্তি।
কিন্তু জনসমর্থপুষ্ট কোনো নেতা যদি সবরকম বিরূপতার মুখেও অবিচল পায়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন তাহলে, ইতিহাস সাক্ষী, তাকে নিকেশ করা যায় না। জনগণের সম্মিলিত শক্তিই তাকে সামনে এগিয়ে দেয় যেমন জোয়ারের প্রবল ঢেউ চরে আটকে পড়া নৌকা ভাসিয়ে নিয়ে যায় কাক্সিক্ষত উপকূলের দিকে।
ইমরান খানের ওপর এই মুহূর্তে পাকিস্তানি জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থা আছে মাস কয়েক আগের জরিপে যেটা ৬০ শতাংশের বেশি। এই তথ্যটি দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়দের ভুলে যাওয়া অনুচিত। ৯ এপ্রিল ইমরানকে বেআইনিভাবে গ্রেফতারের পর যে তীব্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল দেশজুড়ে, তা নজিরবিহীন। এটি শুধু ইমরানের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার প্রকাশই নয়, যারা ফাউল প্লে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য সতর্কবার্তাও। তাদের প্রতি মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ সেটির প্রকাশ ঘটে সেনা স্থাপনায় হামলার ঘটনায়।
পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক। মূল্যস্ফীতি এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ। রিজার্ভ নিঃশেষিত। রেমিট্যান্স কমেছে, রফতানির চেয়ে আমদানির খরচ বিপুল বেশি। আছে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অপচয় এবং সর্বোপরি সুশাসনের অনুপস্থিতি। ঋণভারে জর্জরিত দেশটির জন্য নতুন ঋণ পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। কে আর বেফায়দা কড়ি ঢালবে তলাবিহীন ঝুড়িতে! চীন, সৌদি তাই হাত গুটিয়েছে।
ইমরান তার সমর্থকদের সহিংসতা ও সঙ্ঘাত এড়িয়ে আইনের মধ্যে থেকে আন্দোলন চালাতে বলেছেন। এর আগেও তিনি ২০২২ সালে লং মার্চের কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন সঙ্ঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে। এটি ঠিক কাজ। ক্রিকেটে ঢিল ছুড়ে স্টাম্প ভেঙে দিলেই ম্যাচ জেতা যায় না। নিয়ম মেনে বল করতে হয়। রাজনীতিতেও আইন মেনে উইকেট ফেলাই নিয়ম। বিশেষ করে বিরোধী দলে থাকতে। সরকার বেআইনি পথে চললে আমরাও বেআইনিভাবে চলব বা আইন হাতে তুলে নেবো এমনটা বলার সুযোগ নেই যদিও ‘একটা লাশ পড়লে ১০টা লাশ পড়বে’ এমন কথা বহু আগেই শুনেছি। এটা তারাই বলতে পারে যাদের ক্ষমতায় যেতে ভোট লাগে না।
ইমরানের ভোটের দরকার আছে। পাকিস্তানে নির্বাচন এখনো যথেষ্ট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। বাইশ গজে ইমরানের চোখ উইকেটের নিশানা পেতে কমই ব্যর্থ হয়েছে, তিনি বিশ্বজয় করেছেন। কিন্তু ক্রিজ যখন পুরো মানচিত্র, তখন প্রতিপক্ষ নির্দিষ্ট নয়, অগণিত। ময়দানের এবং ময়দানের বাইরের। দৃশ্যমান প্রতিপক্ষ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্থাপন সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা এবং দেশের সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যজোট। এরা ইমরানকে রাজনীতির ময়দান থেকেই শুধু নয়, দুনিয়ার জীবন থেকেই সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তার ওপর গুলি চালানো হয়েছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ইমরানের শক্তি এটাই যে, অন্য সব দলের মতো ক্ষমতায় গিয়ে বেপরোয়া দুর্নীতির রেকর্ড তার দলের নেই। তার নিজেরও নেই। সেজন্যই তাকে কোনোভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণ করতে চায় সরকার। এতিমের টাকা না হোক, রিয়েল এস্টেটের মামলায় হয়তো ফাঁসানো যেতে পারে!
কিন্তু ইমরান এখন যে অবস্থানে, যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন সেখানে বাইরের শত্রুরা এখন তাকে আর ঘাঁটাবে মনে হয় না। বরং তার সঙ্গে দেন-দরবারের পথে যাচ্ছে তারা। এমনকি ক্ষমতাসীন সরকার যেসব অন্যায় করে চলেছে ক্ষমতায় গেলে ইমরান তাদের রেহাই দেবেন কিনা সেই কথাবার্তাও হচ্ছে বলে শোনা যায়। সমস্যা হলো, পাকিস্তানে কোনো মিডিয়াই ইমরানের সব খবর ছাপতে পারে না। আছে মারাত্মক সরকারি সেন্সর। আছে সাংবাদিকদের গুম খুন নির্যাতনের লাগাতার ধারাবাহিকতা। সেজন্য মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য সামাজিক মাধ্যম থেকে অনেক খবর নিতে হয়। জানা যাচ্ছে, ইমরান কোনো মোড়লের মোড়লিপনা, সেনাবাহিনীর ছায়া সরকার হয়ে থাকার সুযোগ বহাল রাখা, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচারকারী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের মাফ করে দেয়া ইত্যাদি কোনো প্রস্তাবেই সম্মত হননি। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ‘না’ বলে দিয়েছেন। বলেছেন, ক্ষমতায় যাবার জন্য মোড়লের সহয়তা না, জনগণের মদদই তিনি চান। এখানেই ইমরান উপমহাদেশের সব নেতাকে ছাড়িয়ে উঠেছেন।
সর্বশেষ খবর এই যে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করা এবং কোর্ট প্রাঙ্গণে সরকারি জোটের পেশি প্রদর্শনী দেশে একটি সার্বিক নৈরাজ্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অবস্থান থেকে এখন আর নড়তে পারবেন না। নির্বাচন দিলেই বিপুল ভূমিধস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসবেন ইমরান। একজন একজন করে ধরবেন দুর্নীতিবাজদের। সুতরাং নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই ইমরানকে সরিয়ে দিতে হবে। রাজনীতি থেকে, দুনিয়া থেকে। কথাটা বলেছেনও মুখ ফুটে দেশটির স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হয় ইমরান খান টিকে থাকবেন আর না হয় আমরা।’ সরকার কতটা ভীত, এতে বোঝা যায়। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। ইমরান অসুরপুরে আগুন দিয়েছেন। ৭৬ বছরে যে সাহস করেনি কোনো রাজনীতিক সেই দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন। তিনিইবা পিছিয়ে আসবেন কিভাবে? অতএব, লড়াই হবে। একপক্ষে সেনা ও সরকার আরেক পক্ষে ইমরান। বিচার বিভাগকেও সরকার প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। ইমরান যদি শারীরিকভাবে টিকে থাকতে পারেন তাহলে নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা মুসলিম বিশ্ব একজন বলিষ্ঠ নেতা পাবে যার ওপর আস্থা রাখা সম্ভব।
যাই হোক, সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার একটি চলমান মামলার শুনানি করেছেন ওই ১৪ মে তারিখেই। তবে রায় ঘোষণা করেননি। বাইরে মরিয়ম ও মাওলানার বিক্ষোভ চলছিল। শঙ্কা ছিল, এজলাসেও হামলা হতে পারত। তাই আদালত রায় ঘোষণার দিন ঠিক করেছেন ২৩ মে।
যে সরকার আদালতের নির্দেশ উড়িয়ে দিয়েছে, সব রকম আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছে তারা সুপ্রিম কোর্টের ২৩ তারিখের রায় মানবে, এমন মনে করার কারণ নেই। কী হবে, যদি সেদিন আদালত অবমাননার দায়ে সরকারকেই ক্ষমতায় থাকার অযোগ্য ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট?