সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ায় নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। এটি এক অর্থবছরের হিসাবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে এপ্রিল মাসেই নেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৯ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কড়াকড়ি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক ধারায় নেমেছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। সরকারের রাজস্ব আদায়েও চলছে ধীরগতি। এমন বাস্তবতায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়েই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঢালাওভাবে ঋণ নিচ্ছে সরকার। তবে এবার বাংকঋণের সিংহভাগেরই জোগান দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। কারণ তারল্যে টান পড়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্রতিবছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত থেকে। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তারল্য সংকট থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে চাইলেও প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না সরকার। আবার ঋণ পেলেও সুদের হার বেশি দাবি করা হচ্ছে। কারণ করোনার পর চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক কয়েক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা চলছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। রাজস্ব আদায়ও লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের আয় কম বলেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এর প্রভাব সরাসরি মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমাতেই হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে। এজন্য সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাস টানা দরকার, যাতে বাজেট ঘাটতি কম হয়।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সরকার যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তখন টাকা ছাপিয়ে সেই টাকা সরকারকে দেয়। এটাকে ‘হাই পাওয়ার্ড মানি’ বলে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় এবং টাকার মান কমে যায়। এটা অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করে। আর এমনিতেই আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৩৯ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত ৩০ এপ্রিল শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। গত ৩০ জুনে যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৮২ হাজার ৫৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
গত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৮৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। তবে শেষ কার্যদিবস ৩০ এপ্রিল এক দিনে ২ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা পরিশোধ করায় নিট ব্যাংকঋণ ৮২ হাজার ৫৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। যদিও গত মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার কোনো ঋণই নিতে পারেনি। উল্টো আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করে আসছিল। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার রেকর্ড ৭৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছিল মাত্র ৩৪ হাজার ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ৭ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছিল ২৬ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। এছাড়া গত অর্থবছরের পুরো সময়ে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি তার আগের তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। তবে এবার সেই রেকর্ডও ভাঙল সরকার।