জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সবার দৃষ্টি। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি অংশ না নিলেও আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারও ত্রিমুখী লড়াই হতে যাচ্ছে। ঢাকার অদূরের এই সিটিতে এক দশক আগে নির্দলীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের দুজন, বিপরীতে বিএনপির একজন প্রার্থী ছিল। সেবার বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেছিল। দেশের সর্ববৃহৎ এই সিটির ভোটে এবার আটজন মেয়রপ্রার্থী ভোটের মাঠে আছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা, সাবেক আলোচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন (টেবিলঘড়ি) এবং গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি হাসান সরকারের ভাতিজা আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম রনির মধ্যে মূল লড়াই হতে পারে। এবারও ক্ষমতাসীন দলের এই বিভক্তিতে বিএনপি পরিবারের সন্তান রনি সরকারের সুবিধা হবে কিনা, ভোটের মাঠে সেই সমীকরণ চলছে।
আগামী ২৫ মে হতে যাওয়া এই নির্বাচনে ফিরে এসেছে ২০১৩ সালের স্মৃতি। এরই মধ্যে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে কোনো উদ্যোগ আওয়ামী লীগ নেবে না, জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
জাহাঙ্গীর আলম তার মাকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, সে (জাহাঙ্গীর) আওয়ামী লীগ করত, আওয়ামী লীগ থেকেই মেয়র হয়েছিল। কিন্তু তার মা তো কখনো প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। কাজেই তাকে তো আমাদের বিরত রাখার কোনো বিষয় নেই।
আগামী ২৫ মের এই নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে। ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন, মহিলা ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন। এ ছাড়া হিজড়া ভোটার আছেন ১৮ জন। মনোনয়ন জমা-প্রত্যাহারসহ তফসিলের প্রাথমিক পর্ব পেরিয়ে প্রার্থীরা এখন প্রচারমাঠে। মেয়র পদে মোট আট প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেনÑ আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙল), গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম (মাছ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান (হাতপাখা), স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন (টেবিলঘড়ি), শাহনুর ইসলাম রনি (হাতি), রাজু আহম্মেদ (গোলাপফুল) ও হারুন অর রশিদ (ঘোড়া)।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্ষীয়ান নেতা অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আছেন। কারণ টঙ্গী পৌরসভার সাবেক এই মেয়রের মূলশক্তি দলীয় ভোট। এ ছাড়া একক এলাকা হিসেবে টঙ্গীতে ভোট সবচেয়ে বেশি, যা আজমত উল্লার জন্মস্থান। অন্যদিকে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম তৃণমূল ভোটারের কাছে জনপ্রিয়। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন নির্বাচন কমিশনে বাতিল হওয়ার পর তিনি তার মাকে নিয়ে ভোটারদের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এক্ষেত্রে শ্রমজীবী ও নারী ভোটারদের ভোট টানতে তারা বেশি তৎপর। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও দলটির গতবারের প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনূর ইসলাম রনি এবারের স্বতন্ত্র প্রার্থী। তিনিই স্থানীয় বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ভরসা বলে মনে করা হচ্ছে। টঙ্গীর প্রভাবশালী সরকার পরিবারের প্রার্থী রনিকে অনেকেই ভোট দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েই বলেছিলেন, তৃণমূল বিএনপি তার সঙ্গে আছে। তার চাচা হাসান সরকারের দোয়াও রয়েছে। দলীয় নির্দেশের কারণে চাচা তার প্রচারে নামতে না পারলেও কোনো আক্ষেপ নেই রনির। এদিকে গত নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী নাসির উদ্দিন হাতপাখা প্রতীকে ২৬ হাজার ৩৮১ ভোট পেয়েছিলেন। এবার হাতপাখার প্রার্থী রয়েছে। এ ছাড়া প্রার্থী দিয়েছে জাতীয় পার্টিও।
স্থানীয়দের সাথে আলাপে জানা যায়, এবার ভোটের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নানা জটিল হিসাব আছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি এ শহরে বিপুলসংখ্যক ভাসমান মানুষ ও কারখানা শ্রমিকের বসবাস। অনেকে মনে করেন, শিল্পকারখানা ও ভাড়া বাসার মালিকরা শ্রমিক ভোটারদের নিয়ন্ত্রক। এ ছাড়া আঞ্চলিকতা ও ধর্মীয় ইস্যুর প্রভাবও রয়েছে। যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, সেই তরুণ ভোটারদেরও গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা থাকবে নির্বাচনে।
জানা গেছে, গত ৫ বছরে গাজীপুর সিটির ভোট বেড়েছে ৪২ হাজার ৪৬৫টি। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই স্থানীয় তরুণ ভোটার। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কাজের জন্য অন্য জেলা থেকে এসে সিটি করপোরেশন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, এমন ভোটারের সংখ্যাও প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এই সাড়ে তিন লাখ ভোটারের ভোট নিজেদের বাক্সে আনতে সব পক্ষই মরিয়া। এককভাবে শ্রমজীবীদের ভোট বেশি হওয়ায় তারাই শেষ পর্যন্ত ভোটে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বলে আলোচনা চলছে।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান পোশাককল শ্রমিকদের ভোটের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, গাজীপুর শিল্প অধ্যুষিত এলাকা। শ্রমিকদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এসব শিল্পকারখানার শ্রমিকরা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। আমার অন্যতম বিবেচনায় শ্রমিকরা। আমি নির্বাচিত হতে পারলে শ্রমিকদের কল্যাণে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করব।
নিজে প্রার্থী হতে না পেরে মা জায়েদা খাতুনের পক্ষে আটঘাট বেঁধে নেমেছেন গতবারের বিজয়ী মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, তিনি দীর্ঘদিন পোশাক কারখানার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে কাজ করেছেন। গাজীপুরে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করেছেন। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। কোথাও কোনো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হলে তিনি তা মেটাতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থেকেছেন। তার মা নির্বাচিত হলে জাহাঙ্গীর আলম তার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবেন, বলছেন ভোটারদের।
আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম বলেন, টঙ্গী অপরিকল্পিত শিল্পায়নের এক নম্বর উদাহরণ। আমি বিজয়ী হতে পারলে পরিকল্পিত শিল্পায়নের পরিবেশ তৈরি করব; বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাবেন শিল্পকারখানার শ্রমিকরা।
গাজীপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আনোয়ার সাদাত সরকার বলেন, গাজীপুরে শ্রমিক ভোটাররা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবারও নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারেন শ্রমিকরা। যে প্রার্থী শ্রমিকবান্ধব হবেন, শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আশ্বাস দিয়ে শ্রমিকদের মন জয় করতে পারবেন, তার ওপরই এবার ভোটাররা আস্থা রাখতে পারেন।
এ ছাড়া ভোটের ক্ষেত্রে অঞ্চল হিসেবে টঙ্গী গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। একক এলাকা হিসেবে টঙ্গীতে ভোট সবচেয়ে বেশি। বিপুল সংখ্যক ভাসমান মানুষ ও কারখানা শ্রমিকরা এখানে বসবাস করেন। বলা হয়ে থাকে টঙ্গীতে যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন তিনিই গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হবেন। শুধু টঙ্গীতেই (৪৩-৫৭) ১৪টি ওয়ার্ডের মোট ভোটার ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬২০ জন। যা মোট ভোটারের ৩২ শতাংশ। এবার টঙ্গী থেকে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান ও টঙ্গীর প্রভাবশালী সরকার পরিবারের সাবেক যুবদল নেতার ছেলে সরকার শাহনুর ইসলাম।
সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ২০১৩ সালে প্রথম নির্বাচনে এখানে বিএনপি জয়ী হয়। সেবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজতম উল্লা, একই দলের নেতা জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপি সমর্থিত অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ত্রিমুখী লড়াইয়ে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় বার আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এবারের নির্বাচনে মোট মেয়রপ্রার্থী ৮ জন। ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী ২৪৩ জন ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা ৭৮ জন। সিটি করপোরেশনে ৫৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৪৮০টি।
২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। ভোট পড়েছিল ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৯টি। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৬৩৮ ভোট বাতিল হয়েছে বিভিন্ন কারণে। ফলে মোট বৈধ ভোটের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৬ লাখ ৩০ হাজার ১১১টি। সেই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম নৌকা প্রতীকে ৪ লাখ ১০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের ধানের শীষ পেয়েছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট। মেয়র পদের অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুর রহমান মিনার প্রতীকে ১ হাজার ৬৫৯ ভোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাসির উদ্দিন হাতপাখা প্রতীকে ২৬ হাজার ৩৮১ ভোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিন মোমবাতি প্রতীকে ১ হাজার ৮৬০ ভোট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবির কাজী মো. রুহুল আমিন কাস্তে প্রতীকে ৯৭৩ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ টেবিলঘড়ি প্রতীকে ১ হাজার ৬১৭ ভোট পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য জাহাঙ্গীরকে ২০২১ সালের নভেম্বর দল থেকে বহিষ্কার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পরে মেয়র পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এরপরে দল তাকে ক্ষমা করলেও এবার মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়নি। পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু ঋণখেলাপি হিসেবে তার মনোনয়ন বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি। কিন্তু হাইকোর্টেও ইসির সিদ্ধান্ত বহাল থাকায় লড়াই থেকে সরাসরি ছিটকে যান জাহাঙ্গীর। এর পর তিনি তার মায়ের হয়ে মাঠে নেমেছেন।