প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে গত এক বছরে অন্তত হাজার কোটি টাকার ভয়ংকর প্রাণঘাতী মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস দেশে ঢুকেছে। এ সময় ধরা পড়েছে অর্ধশত আইসের ছোট-বড় চালান। গত ১২ দিনে দুটি বড় চালানে উদ্ধার করা হয়েছে ২০০ কোটি টাকার আইস। সীমান্তে আইসের কারখানাগুলো বন্ধের বিষয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও তারা সাড়া দিচ্ছে না। একসময়ের শহুরে ক্রেজি ড্রাগ এখন গ্রামেও তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে নষ্ট হচ্ছে সমাজ। অশান্তি হচ্ছে পরিবারে। এই আইস মাদক এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন মহলে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে ৩৬ কেজি আইস জব্দ করা হয়। ২০২২ সালে জব্দ হয়েছে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। আর গত ১২ দিনে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪ কেজি আইস। যার বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত শনিবার কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল থেকে ২৪ কেজি আইস জব্দ করে র্যাব, যা দেশে এখন পর্যন্ত জব্দ করা আইসের সবচেয়ে বড় চালান। যার বাজার মূল্য ১২০ কোটি টাকা। এর আগে গত ২৬ এপ্রিল সীমান্তের রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে দেশে আনার সময় ২১ কেজি ৯০ গ্রাম আইসসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। গত এক মাসে মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসার সময় অন্তত পাঁচটি আইসের বড় চালান জব্দ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইস সেবনে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতা স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এতে নিদ্রাহীনতা, স্মৃতিবিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতিসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে এই মাদক সেবনে ওজন হারানো, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা, স্ট্রোকের মতো বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে সেবনকারী হয়ে যায় পরিবার ও সমাজের বোঝা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা আমাদের সময়কে বলেন, ইয়াবা ও আইসের মূল উপাদান এমফিটামিন। ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে ১০-১২ শতাংশ। সেখানে আইসে এমফিটামিনের পরিমাণ ৯৬ শতাংশ। আইস ব্যবহারে ইয়াবার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতি। আইস নিয়মিত সেবনে দেড় মাসের মাথায় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতা বদলে যায়। স্বাভাবিক নড়াচড়া ও চিন্তা করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। একসময় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায়।
আইসের শারীরিক ক্ষতির ব্যাপারে তিনি বলেন, আইস একবার ব্যবহার শুরু করলে প্রতিদিন পরিমাণ বাড়াতে হয়। দেড় বছরের মধ্যেই কিডনি ও লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নষ্ট হতে শুরু করে। শারীরিক গঠন ও সুস্থতার ওপর নির্ভর করে কয়েক বছরের মাথায় স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। সেবনকারী শারীরিকভাবে পঙ্গু ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় পরিবার ও সমাজের কাছে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে দেশে ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের ছোট-বড় চালান। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল দিয়ে ঢুকছে সবচেয়ে বেশি। সেখান দিয়ে আইসের চালান প্রথমে উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে আনা হয়। সেখানে মজুতের পর ছোট ছোট চালান আকারে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করে। পাচারের সময় বাহক ধরা পড়লেও হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অন্তত শতাধিক আইস কারবারি রয়েছে। তারা ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতেও ইয়াবার মতো আইস ছড়িয়ে দিচ্ছে। যে চ্যানেলে ইয়াবা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, আইস বিক্রিতেও একই চ্যানেল ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে দ্রুত শহরের পাশাপাশি গ্রামে আইস ছড়িয়ে পড়ছে।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ বলেন, কারা কোন পথে, কীভাবে আইস আনছে সেসব বিষয় জানতে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। আইসসহ মাদকবিরোধী বিভিন্ন অভিযান চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, আইসে মিথাইল অ্যামফিটামিন থাকে ৯৬ শতাংশ। যা ইয়াবার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। অল্পমাত্রায় আইস সেবন করলে বেশিমাত্রায় আসক্তি সৃষ্টি হয়। এতে সবচেয়ে বেশি এবং দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক। লিভার, কিডনি, দৃষ্টিশক্তি, স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি, শ্রবণশক্তি, চেতনাশক্তি, স্মৃতিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যের কারণে প্রথম দিকে শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানরা আইস ব্যবহার করত। অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা ও ধানমন্ডিতে আইস কেনাবেচা হয় বেশি। তবে চাহিদা থাকায় সরবরাহ যেমন বাড়ছে, তেমনি মূল্যও প্রথম দিকের চেয়ে একটু কমেছে। এ কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও আইসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ঢাকায় এর ব্যবহার বেশি। তবে গ্রামেগঞ্জেও আইস ছড়িয়ে পড়েছে। এর চাহিদাও বাড়ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, শনিবার অভিযানে ২৪ কেজি ২০০ গ্রামের চালানটি দেশে এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া আইসের সর্ববৃহৎ চালান। মাদক কারবারিরা সীমান্তের দুর্গম পথ দিয়ে মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আনার পর গভীর পাহাড়ের ভেতরের আস্তানা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তা মজুদ করে রাখে। এরপর সুবিধাজনক সময়ে কক্সবাজার ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক পাচার করে। আইস কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব কাজ করছে।