ঈদের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এক দফা বাড়লেও ঈদপরবর্তী বাজারে চিনি, পেঁয়াজ, আদা, আলুসহ আট পণ্যের দাম নতুন করে বেড়েছে। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে তরিতরকারিও। বাজারে এসব পণ্যের দামে হঠাৎ উলম্ফনে ভোক্তার খরচের চাপ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী। আয়ের চেয়ে বাজারে ব্যয় ক্রমাগত বাড়তে থাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন তারা।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে পথের ধারে কম দামের সবজির দোকানে দাঁড়িয়ে দিনমজুর মো. আবু হানিফ আক্ষেপ করে বলেন, রান্নায় তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন লাগেই। অথচ এসব পণ্যের দাম বাইরা গেছে। শুক্রবার আইলে দাম আরেক ধাপ বাড়ে। এত খরচ করে বাজার করার সামর্থ্য নাই আমার। সামান্য তরিতরকারিও কিনতে হয় হিসাব কইরা। বাজারের ভিতর বেশি দাম, তাই এইখানে আসছি। নিম্নমানের হইলেও দামে একটু কম। কিন্তু এইখানেও হিসাব করে কিনতে হইতাছে। দিনমজুর
হানিফের মতো খরচের চাপ বেড়েছে মধ্যবিত্তদেরও। কারওয়ানবাজারে বাজার করতে এসে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সিরাজুল ইসলাম বলছিলেন, রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে গেছে। এতে মাসের হিসাবে অনেক টাকা খরচ বেড়েছে। দেশি আদার দাম ২৪০ টাকা হয়ে গেছে। সামান্য আলুর দামটাও ৫ টাকা বাড়তি। চিনির দামে আগুন। বাড়তি দামেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। এতসব খরচের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।
বাজারের পেছনেই বেতনের সিংহভাগ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এতে অন্যান্য প্রয়োজনের পেছনে ব্যয়ে টান পড়ছে।
রাজধানীর কারওয়ানবাজার, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী ও কদমতলীসহ বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদপরবর্তী সময়ে অনেকগুলো পণ্যের দাম বেড়েছে। সপ্তাহ তিনেকের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরায় এ পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। ঈদের আগেও যা ৩৫ টাকায় কেনা গেছে।
ভরা মৌসুমেও পেঁয়াজের দাম এত বেড়ে যাওয়ায় হতবাক ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরাও। অথচ রাজধানীতে পেঁয়াজ সরবরাহকারীদের অনেকে বলছেন, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েকটি চক্র পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলার স্থানীয় মোকামেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে এ পেঁয়াজ।
এদিকে, বড় আলুর দাম হঠাৎ কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৩৭ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আদার দামেও আগুন লেগেছে যেন। দেশি আদা কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকৃত আদা অনেক দোকানে উধাও। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি কমে গেছে। দামও বাড়তি। এ সুযোগে দেশি আদার দামও একলাফে অনেক বেড়েছে। অপরদিকে রসুনের দামও বাড়তি। দেশি ও আমদানি রসুন কেজিতে ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কদমতলী সাদ্দাম মার্কেট বাজারের ঈশানা স্টোরের বিক্রেতা মো. ইসমাইল বলেন, দেশি আদাই বিক্রি করছি ২৪০ টাকা কেজি। বিদেশি আদা পাইকারি বাজারে পাই নাই। তাই বিক্রি করছি না। এলসি সমস্যার কারণে সেটার দামও অনেক বেড়েছে।
চিনি নিয়ে সিন্ডিকেটের ছিনিমিনি এখনো চলছে। সরকার খোলা চিনির সর্বোচ্চ দাম ১০৪ টাকা কেজি বেঁধে দিলেও ব্যবসায়ীরা তা উপেক্ষা করে দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছে। খোলা চিনি এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এখানেই শেষ নয়, এত বাড়তি দামেও চিনির দেখা মিলছে না অনেক দোকানে।
মালিবাগ বাজারের বিপ্লব স্টোরের ব্যবসায়ী মো. সোলায়মান বলেন, সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে ১০৪ টাকা। অথচ পাইকারি বাজারে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। আবার কেনার সময় পাকা রসিদও দিচ্ছে না। এ অবস্থায় এত দামে চিনি বিক্রি করলে মোবাইল কোর্টের জরিমানার মুখে পড়তে হবে। এ ঝামেলা এড়াতেই চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছি। অন্যদিকে প্যাকেট চিনি অনেক আগে থেকেই উধাও রয়েছে বাজারে।
মৌলভীবাজারের চিনির পাইকারি বিক্রেতা গোলাম মাওলা বলেন, সরকার যে দামই বেঁধে দিক না কেন, মিলগেটে তাদের দামেই বিক্রি করে। আমাদেরকে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। সুতরাং বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে ডিমের ডজনেও ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। অপরদিকে ব্রয়লার মুরগির দাম আগের মতোই নিম্ন আয়ের নাগালের বাইরে রয়েছে। প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত। সবকিছুর দামে যখন দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ তখন শাকসবজি ছিল শেষ ভরসা। কিন্তু সবজির দামও বর্তমানে অনেক চড়া। এর মধ্যে নতুন করে বেশ কয়েকটি সবজির দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবও বলছে, এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ, রসুন ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আদার ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ২১ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। একই সময়ে চিনির দাম ১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং আলুর দাম সাড়ে ৪২ শতাংশ বেড়েছে। সয়াবিনের দাম বেড়েছে।
এদিকে নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে রান্নার তেল সয়াবিনের দাম। গত বৃহস্পতিবার থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারে ১২ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের লিটারে ৯ টাকা বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা।
নতুন দাম অনুযায়ী, ১ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৯ টাকায় বিক্রি হবে, যা এত দিন ছিল ১৮৭ টাকা। খোলা সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হবে ১৭৬ টাকা; যা এতদিন ছিল ১৬৭ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯০৬ টাকা থেকে ৫৪ টাকা বাড়িয়ে ৯৬০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া খোলা পাম সুপার তেল লিটারপ্রতি ১১৭ টাকা থেকে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রান্নায় একরকম অপরিহার্য এ তেলের দাম একলাফে এতখানি বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।