মাহমুদুর রহমান মান্না আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ। ছাত্রনেতা হিসেবেই তার বড় সুখ্যাতি। এরপর একাধিকবার করেছেন দল পরিবর্তন। ছাত্রলীগ থেকে জাসদ, বাসদ, জনতা মুক্তি পার্টি হয়ে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন। বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক। আগামী নির্বাচন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি নয়া দিগন্তের মুখোমুখি হয়েছেন।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন কোন দিকে এগোচ্ছে?
মাহমুদুর রহমান মান্না : সরকার অতীতে জোর করে, ডাকাতি করে দুটো নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে গেছে। এইবার বিষয়টা কঠিন হয়ে যাবে। এটা এখন অনেক বড় বিষয়। মূল ফোকাস জায়গাগুলো থেকে বলছি। এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। দেশের জনগণ এই সরকারের ডাকাতি চরিত্র বুঝে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নিন্দিত হচ্ছে। জাপানের মতো দেশের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, দিনের ভোট রাতের বেলায় করার যেন সুযোগ না হয়। আমেরিকা সুষ্ঠু ভোটের জন্য খুবই চাপ দিচ্ছে। যাতে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। এ ছাড়া দেশে একটা আন্দোলনের বাতাস রয়েছে। বিরোধী দল হয়তো এখন নীরব আছে মনে হচ্ছে ঈদের পর তারা মাঠে নামবে। সব মিলিয়ে বলতে পারি যদি সরকারের মধ্যে শুভ চিন্তা কাজ করে। ভালো একটা বুদ্ধি বিবেচনা কাজ করে। তাহলে তারা পদত্যাগ করে নির্বাচন দেবে। যেহেতু অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলেছে তারা আর এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না। সবাইকে নিয়ে নির্বাচন হলে গণতন্ত্রের উত্তরণের একটা সুযোগ থাকবে।
সরকার যদি অতীতের মতো হার্ডসিদ্ধান্তে থাকে?
মাহমুদুর রহমান মান্না : আর সরকার যদি এবারো গদি না ছাড়ে, তাহলে স্পষ্ট বলতে পারি দেশে একটা সঙ্ঘাত অনিবার্য। সে সঙ্ঘাতে আওয়ামী লীগ সরকার পরাজিত হবে। কোনোভাবে জিততে পারবে না। তাতে হয়তো দেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
মানুষের দৃষ্টিগুলো রাজনীতির চোখে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না : সরকারের দুর্নীতি লুটপাটের কারণে দেশের মানুষ এখন অসহনীয় জীবনযাপন করছে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। দেশে এখন আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই। তারা এখন দেশে করোনার বাঁশি বাজাচ্ছে। কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও করোনা ছিল, সেখানে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু আমাদের দেশের এই পরিস্থিতি শুরু হয়েছে করোনার আরো আগ থেকে। আমাদের দেশে করোনায় কিছু মানুষ যেমন দরিদ্র হয়েছে, তেমনি বড় অংশ ধনী হয়ে গেছে। বিষয়টা একেবারে অচিন্তনীয়। বিশ্বের কোন দেশের সাথে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি মিলে না। বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কেবল গরিব মানুষ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীরা এবং তাদের আত্মীয়স্বজন অনেক বেশি ধনী হয়ে গেছে। তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাই দেশের সব পরিস্থিতি দৃষ্টি থেকে বলা চলে দেশ সঙ্ঘাতের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন ভূরাজনীতিও যুক্ত হচ্ছে। আমাদেরকে সতর্কতার সাথে দৃষ্টি রেখে সামনে পা ফেলতে হবে।
যুগপৎ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কি?
মাহমুদুর রহমান মান্না : যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়টা বুঝতে হবে। এখানে সামগ্রিক বিষয় যুক্ত নয়, কিছু কিছু বিষয়ে শুধু ঐকমত্য। যে বিষয়গুলো মিল রয়েছে সে বিষয়গুলো আমাদের বর্তমান ইস্যুর সাথে দেশের মানুষের সার্বিক বিষয়ের সাথে যুক্ত। আমরা ওই বিষয়গুলোর সমাধান খুঁজে বের করতে চাই। নিজেরা নিজেদের জায়গা থেকে ওই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছি আন্দোলন করছি। আমাদের যুগপৎ আন্দোলনের কমন লক্ষ্য হচ্ছে এই সরকারের পদত্যাগ। একটা অন্তর্র্বর্তী সরকার স্থাপন। সরকার পদ্ধতি ভেঙে দেয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। নির্বাচনের পরে আমাদের কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের মতামত রয়েছে। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সংস্করণ করতে হবে। জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা এখনো চলমান। সবাই এখন এ রকম করে বলছে দেশের এখন যে পরিস্থিতি এটি কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। একটা সংস্কার প্রয়োজন দেশের জনগণের অধিকার এবং নিরাপত্তার জন্য। মানুষ দুর্নীতি থেকে বাঁচতে চায় এবং রাষ্ট্রের সব ব্যবস্থাকে ও রক্ষা করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিএনপির সাথে আপনাদের বোঝাপড়া কেমন?
মাহমুদুর রহমান মান্না : যতদূর আসছি ভালোই আসছি। আগামী দিনে ভালো যাবে আশা করি। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু হাত বাড়িয়ে দিয়েছি বিএনপিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকারবিরোধীরা কি বিএনপিকে সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন কি না?
মাহমুদুর রহমান মান্না : আসলে সহযোগিতা বলতে বিষয়টা বিএনপির সব ধরনের কর্মসূচিতে আমাদেরকে অংশগ্রহণ করতে হবে তেমন নয়। তাদের সাথে আমরা মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতে পারি। আমরা সাহায্য করতে পারি। যতটুকু কল্যাণকর সব বিষয়ে ঠিক ততটুকু বিষয় আমরাও হাত বাড়িয়েছি, বিএনপিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবার আন্দোলন কি সফল হবে?
মাহমুদুর রহমান মান্না : এবারের আন্দোলনকে আমি সফল হিসেবে দেখছি। এরপরও সমস্যার কথা হচ্ছে ঝড়ের মধ্যে যেমন নৌকা ডুবে আবার মাঝির অসতর্কতায় নৌকা ঢুবতে পারে। আন্দোলনের পদ্ধতি রূপরেখা অনেক বিষয়ের সাথে অনেক কিছু যুক্ত। এবারের আন্দোলনে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের জনগণ সবাই পক্ষে। সবাই একটা পরিবর্তন চায়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে বিদেশীরাও এখন কথা বলছেন। তারাও একটা সুন্দর পরিস্থিতি চান। গণতন্ত্রের পক্ষে একটি শক্তিশালী বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচন পরবর্তীতে জাতীয় সরকারের বিষয়টা একটু জানতে চাই
মাহমুদুর রহমান মান্না : আমি এ ধরনের বিষয়ে বিশ্বাসী না। বিশ্বাস করতে চাইও না। এটা তারেক রহমান বলেছে এখন বিএনপিও বলছে। আমরা জাতীয় সরকার বলি না আমরা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলছি। আসলে জাতীয় সরকারের কথা বললে বিএনপি মনে করে সব দল আসবে বিষয়টা আমার মনে হয় না। আন্দোলনের পক্ষের শক্তিগুলো নিয়ে তারা জাতীয় সরকারের কথা বলছেন। উদ্দেশ্যের সাথে কিছু মিল আছে। তবে এ বিষয়টা সম্পূর্ণ বিএনপির দলগত বিষয়। একটা বড় দল জেতার পর অন্য দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করার পর সেটা জাতীয় সরকার। একটা কল্যাণকর রাষ্ট্রের বিষয়। আসলে এটা এখনো মৌলিকভাবে ভবার সময় নয়। সরকারে গেলেই তবে সামগ্রিক বিষয় চিন্তা করা যাবে।
এবার কি বিএনপি ক্ষমতায় আসবে?
মাহমুদুর রহমান মান্না : আমরা তো সাফল্যই দেখছি। কোথায় আছে ঝড়ের মধ্যেও যেমন নৌকো ডুবে। মাঝির অসতর্কতায় আবার নৌকা ডুবে। তবে আমাদের জেতার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। কারণ জনগণ পক্ষে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গণতন্ত্রের বাতাস শক্তিশালী।
নয়া দিগন্ত : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল কতটা শক্তিশালী?
মাহমুদুর রহমান মান্না : সরকার হয়তো পুলিশ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে দিয়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে চীন রাশিয়াকে দিয়ে একটা কৌশল পরিচালনায় বদ্ধপরিকর। কিন্তু যৌথ আন্দোলনে এসব কিছুই টিকবে না। কারণ তারা আদর্শিক নৈতিক বিশ্বাসের ওপর টিকে নেই। কৌশলের কথা যদি বলেন সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার কৌশল একদম নি¤œ শ্রেণী ও মানের। অসৎ মিথ্যায় পরিপূর্ণ। আমি শেখ হাসিনার রাজনীতির কোনো গুণগত কৌশল দেখি না। সবকিছু নোংরায় ভরা।
দলীয় সরকারের অধীনে কি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব?
মাহমুদুর রহমান মান্না : না বর্তমানে তা নেই।
নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক দেশগুলো কেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
মাহমুদুর রহমান মান্না : হ্যাঁ তারা তো করতেই পারে। তারা র্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এ দেশে হত্যা গুম খুন দমন করেছে। তা ছাড়া এই সময় এখন বিরোধীদলীয় দলগুলো মাঠে নামতে পেরেছে। এখন সরকার প্রশাসনকে দিয়ে আগের মতো বাধা দিচ্ছে না। দিচ্ছে তবে আগের মতো না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, তারা চাইলে পারে ওলটপালট করতে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ মনে করে ভারত এ সরকারকে সমর্থন করে। ১৪ সালে নির্বাচনটা হয়েছে তাতে ভারত সরাসরি এ সরকারকে সাপোর্ট দিয়েছে। ১৮ সালের নির্বাচনে হয় তো সরকারের পক্ষে ছিল। কিন্তু ওখানে একটা বিতর্ক হয়। চীনের টাকায় পুলিশ প্রশাসন কিনে রাতের ভোট দিয়েছে। কিন্তু সামনের নির্বাচনে ভারতের প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলি আমেরিকা বেশ সিরিয়াস বাংলাদেশ একটা ভালো নির্বাচন হতে হবে। আমি মনে করি ইন্ডিয়া তাতে দ্বিমত পোষণ করবে না।
সামনে নির্বাচনের ঘোষণা হবে এ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর করণীয় কি?
মাহমুদুর রহমান মান্না : রমজানের পরে তো আমরা আন্দোলনে যাবো। যতটুকু সিরিয়াস দেখছি বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তখন তো আন্দোলন করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান কি রকম মনে হচ্ছে যদি একটু বিশ্লেষণ করতেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না : রাজনৈতিক ও একাত্তরের ভূমিকার কারণে জামায়াতকে মূল্যায়ন করি না। এটা বললেই তো আর মূল্যায়ন হয় না। জামায়াত কখনই তাদের রাজনীতিতে আলাদা কোনো স্ট্যানস সো করেনি। কিন্তু জামায়াতের অনেক শক্তি আছে। তাদের পাঁচজন সিনিয়র নেতার ফাঁসি হয়েছে তারপরও দলটা অটুট আছে। যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে জামায়াত এক দুইবার নেমেছিল। কিন্তু তারপর চুপ হয়ে গেছে। এবি পার্টি কে জামায়াত নিয়ন্ত্রণ করে এটা আমি দেখতে পাইনি। আমি মাঝে মধ্যে এবি পার্টির অনুষ্ঠানে যাই। কিন্তু তাদের ভেতরে সেই রকম কোনো ধর্ম চর্চা দেখতে পাইনি।