বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর বলছে যে- সারা দেশেই মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে এবং এটি আরো কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তাপপ্রবাহের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা বেশ উদ্বেগজনক।
এবছর এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গত ১৭ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
নয় বছর আগে ২০১৪ সালে মারাত্মক তাপপ্রবাহ দেখা গিয়েছিল। সে সময় চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। এই মাঝের সময়টা বা গত আট বছরে দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির নিচেই ছিল বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, বাংলাদেশে তাপমাত্রা ২০ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়বে অর্থাৎ তাপপ্রবাহ থাকবে। শুক্রবার থেকে সারা দেশে তাপপ্রবাহ কিছুটা কমে আসবে।
দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ
আবহাওয়াবিদদের সংগঠন সাউথ এশিয়ান মেটিওরোলোজিক্যাল এসোসিয়েশন-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে যে তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে তা উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, সারাদেশে যে তাপপ্রবাহ চলছে তা সবার জন্যই বেশ উদ্বেগজনক। কারণ তাপের তীব্রতা এতো বেশি যে তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
তাপপ্রবাহ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে সেটা স্বাভাবিক নয় বলেও উল্লেখ করেন তারা।
ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, স্বাভাবিকের একটা মাত্রা আছে। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ চার দিন থেকে সর্বোচ্চ আট দিন স্থায়ী হয়।
‘কিন্তু যখন দেখি ১৪ দিন, এটা ব্যতিক্রম,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে যে তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। বিশেষ করে দেশের একটি জেলা চুয়াডাঙ্গায় গত দোসরা এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১৪ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এটাও উদ্বেগজনক বলে মনে করেন এই আবহাওয়া বিজ্ঞানী।
আবহাওয়াবিদ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, চুয়াডাঙ্গাতে এক দীর্ঘ সময় ধরে একটানা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। এটা খুব একটা দেখা যায় না।
দেশের বেশ কিছু জায়গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া গত ১১-১২ দিন ধরে দেশের কোথাও বৃষ্টিও নেই। এর আগে গত ৫ এপ্রিল সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টির বিষয়ে তিনি বলেন, গত ১৪-১৫ দিন ধরে দেখা যাচ্ছে যে- পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে কিছু মেঘ আকাশে আসছে। তবে এটি বিহার উড়িষ্যা ও ঝাঢ়খণ্ডের কাছাকাছি এসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশ বিহার এলাকায় একটি উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাব রয়ে গেছে। যার কারণে এখানে কোনো ময়েশ্চার ঢুকতে পারছে না।
‘এই ময়েশ্চার যদি আসে তাহলে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশে এবার তাপপ্রবাহ হলেও প্রচণ্ড গরমেও ঘাম খুব কম হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যাওয়া।
আবহাওয়াবিদ ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, গত ১২ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও বাতাসের আদ্রতা ৮ শতাংশে নেমে গিয়েছিল।
‘যেখানে স্বাভাবিকি আর্দ্রতা ৫০, ৬০, ৭০ ও ৮০, সেখানে চুয়াডাঙ্গায় আর্দ্রতা আট পার্সেন্টে চলে গিয়েছিল। ইমাজিন করা যায় এতো কম একটা আর্দ্রতা!’
এমন ঘটনা ব্যতিক্রম এবং খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করেন তিনি।
আবহাওয়াবিদ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, তাপপ্রবাহের সময় যদি আর্দ্রতা কমে যায় এবং এটি যদি ২০-২৫ শতাংশের নিচে নেমে যায় তাহলে সেসময় মানুষের ঘাম হয় না।
এর ফলে মানুষ তাপীয় অবস্থা বেশি অনুভব করে। এই অবস্থা মানুষের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেন কর্মকার।
‘জলীয় বাষ্পটা খুবই কমে যায়, ওই দিকে তাপমাত্রাটাও বেড়ে যায়। এতে অস্বস্ত্বি লাগে।’
তাপমাত্রা উঠা-নামা করছে কেন?
চলতি বছর এ পর্যন্ত ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলেও গত বছর এমন তাপপ্রবাহ দেশে হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সে সময় দেশে সর্বোচ্চ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠেছিল।
বরিশালে ১৯৫৬ সালে ৪৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছিল তাপমাত্রা। এছাড়া ১৯৮৯ সালে বগুড়ায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছিল তাপমাত্রা।
আবহাওয়া অধিদফতরের তাপমাত্রা সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা বলেন, দেশে বিভিন্ন সময়ে তাপপ্রবাহের সময় তাপমাত্রা উঠা-নামা করার বিষয়টি স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, সারা বিশ্বের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যের কারণেই বিভিন্ন সময়ের তাপমাত্রায় পার্থক্য দেখা যায়।
কাজী জেবুন্নেসা বলেন, নরমালি আমরা জলবায়ুর হিসাব ৩০ বছর পর পর করি। এই দীর্ঘ সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে,- ছয় বছর, নয় বছর, ১০ বছর বা ১২ বছর পর পর ওই আগের সাইকেলটা রিপিট হয় বা এ রকম ওয়েদার দেখা যায়।
‘তবে এটা সবসময় যে হবে, এমনো কোনো রেকর্ড নেই।’
আবহাওয়াবিদ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, বায়ুমণ্ডলে বায়ুর বিন্যাসের কারণে কয়েক বছর পর পর তাপপ্রবাহ তীব্রতর হতে দেখা যায়।
তাপপ্রবাহ কম-বেশি প্রতিবছরই হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত এই অঞ্চলে। কিন্তু সব বছর এটা তীব্র হয় না। যে বছর বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ কম থাকে সে বছর তাপপ্রবাহের তীব্রতা বেশি হয়।
এই মৌসুমে কালবৈশাখী বা বজ্রসহ বৃষ্টি হলে তাপপ্রবাহের তীব্রতা কমে যায়। তবে এ বছর কালবৈশাখী বা ঝড় না হওয়ার কারণে তাপপ্রবাহের তীব্রতা বেশি বলেও মনে করেন তিনি।
ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, পরিবেশ মানবসৃষ্ট উপাদান বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা বাড়ার একটি বড় কারণ। কংক্রিটের অবকাঠামো বাড়ার পাশাপাশি গাছ কমে গেছে যা পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
এছাড়া আবহাওয়ার পরিবর্তনশীলতার কারণে কয়েক বছর পর পর তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা যায়। তার মতে, বাংলাদেশ আকারে ছোট হলেও এর আবহাওয়ায় ভীষণভাবে পরিবর্তনশীল।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশে মার্চ-এপ্রিল-মে এই সময়টাকে কাল বৈশাখীর মৌসুম বলা হয়। বছরের এই সময়টাতে ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার কথা। চলতি বছর এই ঝড়-বৃষ্টি কিছুটা হলেও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তবে এপ্রিলের পর থেকে এই চিত্র পাল্টে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝড় হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে আবার একটা শুষ্ক আবহাওয়া দেখা যাবে। তারপর ঢুকবে মৌসুমী বায়ু।
গরম অনুভূত হয় বেশি
রাজধানী ঢাকায় গত ১৬ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছিল।
তবে ঢাকায় বা শহরাঞ্চলে যে তাপমাত্রা তার তুলনায় এটির অনুভূতি আরো কয়েক গুণ হয় বলে জানানো হয়।
ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, শহরাঞ্চল যেখানে ইট-কংক্রিটের স্থাপনা বেশি থাকে সেখানে নদী বা জলাশয় আছে এমন স্থানের তুলনায় তাপমাত্রা অনেক বেশি হয়ে থাকে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তাপের কারণে জলাশয় বা পানি বাষ্পে পরিণত হলে সেটি আবার চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে তাপমাত্রা কিছুটা কম অনুভূত হয়। একই ঘটনা ঘটে গাছের ক্ষেত্রেও। গাছও শেকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে পানি শুষে নিয়ে তার কিছুটা আবার বাষ্পাকারে পাতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ফলে গাছের নিচেও ঠান্ডা অনুভূত হয়।
অপরদিকে ইট বা কংক্রিটের অবকাঠামোতে তাপ বা সূর্যের কিরণ পড়লে তা শুষে না নিয়ে বরং প্রতিফলন ঘটে তা আবার পরিবেশেই ছাড়া হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে পিচ ঢালা রাস্তায়ও। যানবাহনের ক্ষেত্রেও এগুলোর বডি বা কাঠামো তাপে গরম হচ্ছে, পরে আবার এই তাপ পরিবেশে ছাড়ছে। ফলে ‘ডুয়াল’ বা দ্বৈত প্রভাবের কারণে তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেন বাস্তবে তাপমাত্রার অনুভূতি আরো অনেক বেশি হচ্ছে।
এছাড়া শহরাঞ্চলে যেভাবে গায়ে গা লাগিয়ে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়, তাতে প্রতিটা ভবন গরম হওয়ার পর সেটি আবার এক সময় তাপ ছেড়ে দেয়। কিন্তু আশপাশে জায়গা না থাকার কারণে, গাছপালা বা সবুজ না থাকার সেই তাপ শোষিত না হয়ে পরিবেশ ছড়িয়ে পড়ে।
‘মরুভূমির উত্তপ্ত বালু সারাদিন গরম হয়ে রাতে হঠাৎ করে যে তাপ ছেড়ে দেয়, দেশেও সেরকম হচ্ছে।’
এছাড়া শীতকালে শৈত্যপ্রবাহও দেখা যায়। আবহাওয়ার এসব পরিবর্তনের কারণে দেশে প্রতিবছর আবহাওয়া একই ধরণের আচরণ করে না। তবে এটা জলবায়ুর সাথে সম্পর্কিত নয় বরং এটা আবহাওয়ার সাথে সম্পর্কিত বলেও জানান দাশ।
এছাড়া এলনিনো এবং লা-নিনার প্রভাবও দৈনন্দিন আবহাওয়ার উপর পড়ে। এদের মধ্যে একটি সমুদ্রের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। যার কারণে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রভাব পড়ে। আরেকটি খরা-বন্যা তৈরি করে। যে বছর যে বিষয়টি সক্রিয় থাকে সেবছর সেরকম আবহাওয়া দেখা দেয়।
আবহাওয়া ও সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, বাংলাদেশের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে সেটি বেশ উদ্বেগনজক এবং এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ইতিহাসের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এই যে ১৪ দিন ধরে যে তাপমাত্রাটা বেড়েছে সেটা একেবারে হঠাৎ করেই বাড়েনি। বরং ধীরে ধীরে এটি বেড়েছে। আবার মাঝে কখনো হয়তো কমেছেও।
তবে এখন থেকে ২০ বছর পর দেশের তাপমাত্রা যে আরো বাড়বে সেটি নিয়ে সন্দেহ নেই বলেও মনে করেন এই আবহাওয়া ও সমুদ্র বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, তাপমাত্রা কোন একটি কারণে বাড়ে না। বরং বিভিন্ন উপাদানের সমন্বিত পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেশি হয়।
তাপমাত্রা বাড়ার একটা বৈশ্বিক প্রভাবও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব কাছের যে অবস্থান সেটি হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পৌঁছে গেছে বাঁকুড়াসহ কিছু কিছু জায়গায়। ভারতে এর আগে তাপপ্রবাহে বেশ কিছু প্রাণহানিরও খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানেও তাপপ্রবাহ চলছে। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহে এগুলোরও একটি প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশে টানা তাপপ্রবাহ বা প্রচণ্ড গরম থাকলেও গত দুই দিন আগ পর্যন্ত কোনো বাতাস ছিল না। একে আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় কাম উইন্ড বা স্বস্তির বায়ু প্রবাহ বলা হয়।
তাপপ্রবাহ শুধু স্থলভাগে নয় বরং সাগরেও হচ্ছে বলে জানান ড. মোহন কুমার দাশ। আর এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে তাপের কারণে যে জলীয় বাষ্প তৈরি হচ্ছে তা সরতে পারছে না।
অর্থাৎ সমুদ্রে যে জলীয় বাষ্প তৈরি হয়েছে বাতাস না থাকার কারণে সেটি ভূ-ভাগে আসতে পারছে না। একই সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশালকার স্থলভাগ জুড়ে শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করছে।
সূত্র : বিবিসি