রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি ব্যাংকের এবং একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ (এফডিআর) আটকে গেছে ২৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই)। এসব এফডিআর মেয়াদপূর্ণ হওয়ার পর নগদায়ন না হয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুনঃনবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) লোপাটের শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাংকগুলোর এফডিআরের প্রায় ৮৩৩ কোটি ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রভাব খাটিয়ে এফডিআর নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতে এফডিআর পুনঃনবায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ও সুশাসন যাচাই করার জন্য একটি কমিটি গঠন করার। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে এফডিআর সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ কর্তৃক প্রভাব বিস্তার এবং কোনো প্রকার অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা হচ্ছে কিনা, আগেই সে বিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করা।
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করণীয় নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একটি নোট উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সূত্রমতে, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি পিকে হালদার জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে প্রথমে অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে পুনর্গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) আর্থিক অবস্থা বর্তমানে নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের ৮৯-৯৬ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। সঙ্গত কারণেই দীর্ঘসময় পেরিয়ে গেলেও এফডিআরের টাকা ফেরত পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা আমাদের সময়কে বলেন, যখন বিনিয়োগ করা হয়েছিল, তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। পরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই টাকাও আটকে যায়। টাকা ফেরত দেওয়ার তাগিদ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়ে অবগত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তখন তারা নতুন নতুন পণ্য আনাসহ অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যার মাধ্যমে পুরো আর্থিক খাতের উন্নয়ন হয়। কিন্তু এগুলো তো হলোই না, বরং দেখা গেল এসব প্রতিষ্ঠানও ব্যাংকের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েও অর্থায়ন করছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকের মতোই কাজ করে, তা হলে এগুলোর দরকারটা কি? তারা পুরো খাতেই সমস্যা তৈরি করেছে। ব্যাংকগুলো তাদের এফডিআরের টাকা ফেরত পাচ্ছে না। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাবও দায়ী। এটা অবশ্যই আর্থিক খাতের জন্য ভালো বার্তা নয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পিকে হালদার প্রথমে ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি। পরে তিনি নতুন প্রজন্মের এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হন। ব্যাংকটির এমডি পদে থাকাকালেই তিনি আর্থিক জালিয়াতি শুরু করেন এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গত বছরের মে মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পিকে হালদার গ্রেপ্তার হলেও তার নিয়ন্ত্রণাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা এফডিআরের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও একটি সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ ১-এ পাঠানো ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং একটি সরকারি এনবিএফআই বিআইএফএফএল কর্তৃক ২৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর হিসেবে প্রায় ২ হাজার ৯৯২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে পিকে হালদারের সহযোগীদের যোগসাজশ ও নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের প্রায় ৮৩২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ফেরতপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃক দুটি রাষ্ট্র্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে প্রভাব বিস্তার করে এফডিআর সংগ্রহ করার বিষয়টিও ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে তা গত সপ্তাহে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে পাঠানো হয়। পরে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ নোট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উপস্থাপন করা হয়। ওই নোটে বলা হয়, সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত সংরক্ষণের বিপরীতে কোনো প্রকার অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছে বা হচ্ছে কিনা, আগেই সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগ হিসেবে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগেরই আওতাধীন।
এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিভিন্ন নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত এফডিআর পুনঃনবায়নের ক্ষেত্রে কমিটি গঠনের বিষয়টিও বিআরপিডি কর্তৃক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যথাযথ হবে মর্মে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে এ সব রাষ্ট্র্রায়ত্ত ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ আমানতের বিপরীতে ঝুঁঁকি নির্ধারণ, সংস্থান সংরক্ষণ, আর্থিক বিবরণীতে প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়ে বিআরপিডি কর্তৃক নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধাসহ সার্বিক সমন্বয়ের সুবিধার্থেও কমিটি গ্রহণের উদ্যোগ বিআরপিডি কর্তৃক গ্রহণ করা অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কোনোরূপ অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য ব্যয় নির্বাহ করছে কিনা বা এফডিআর সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অনৈতিক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগকে অনুরোধ জানানো যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭০ হাজার ৪১৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এই হার এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।