নওগাঁয় র্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিনের শুধু মাথাতে আঘাতই নয়, শরীরে আরও আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। ময়নাতদন্তের সময় জেসমিনের হাতের কনুইয়ে জমাট রক্তও পাওয়া গেছে।
জেসমিনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক বিভাগের তিনজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্তে জেসমিনের মাথা ও ডানহাতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার ব্রেনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। জেসমিনের মরদেহ পুলিশের কাছ নেওয়ার পর আমরাই তার ডানহাতের কনুইয়ে কালশিরা দাগ দেখেছি। ময়নাতদন্তের সময় সেখানে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে’।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। তবে বিষয়টি নিয়ে চতুর্মুখী চাপে আছেন বলে স্বীকার করেন তিনি।
রামেক হাসপাতালের ডেথ রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, জেসমিন মারা গেছে শুক্রবার সকাল ১০টায়। তার মরদেহ গ্রহণ করেছেন সুরভী নামের এক নারী। হাসপতাল থেকে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ পাশের ভবনে ফরেনসিক বিভাগে পাঠাতে সময় নেওয়া হয়েছে ২৪ ঘণ্টা।
advertisement
ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমরা শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় পুলিশের কাছ থেকে মরদেহ পেয়েছি। এরপর ১১টার দিকে ময়নাতদন্তের কাজ করি’।
তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যু সনদে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ এবং হার্টফেল মৃত্যুর কারণ বলে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। এ জন্য জেসমিনের হার্টও সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। সবগুলো প্রতিবেদন পেলে আমরা তিনজন চিকিৎসক বসে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাব। তখন মতামতসহ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় আরও চার-পাঁচ দিন সময় লাগতে পারে।’
জেসমিনের মৃত্যুর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গিয়ে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার। তিনি জানান, মাথা ছাড়াও জেসমিনের ডান হাতের কনুইয়ের কাছে তিনি আঘাত দেখেছেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে এসব আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে বসেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হক। এনামুল হকের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাকরি দেওয়ার নামে ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে চাঁদপুরের হাইমচর থানার গাজীবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আল আমিন ও নওগাঁর চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার মামলা করেন তিনি। রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করা হয়।
আমাদের সময়ের সাথে আলাপকালে এনামুল হক জানান, তার নিজের নামে ফেসবুক আইডি থেকে নানা প্রলোভনে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় ছন্দা জোয়ার্দার নামে এক নারী মামলা করেন গত বছরের অক্টোবরে। এই মামলার আসামি তিনি (এনামুল হক) ও তার স্ত্রী পরিচয় দেওয়া রোমানা ফেরদৌস নামে এক নারী। প্রাইমারি স্কুলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ছন্দার কাছ থেকে এ টাকা নেওয়া হয়।
ওই মামলায় তিনি ঢাকার আদালতে হাজিরা দেন। বর্তমানে জামিনে আছেন। তবে এনামুল হক দাবি করছেন, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে প্রতারকচক্র এক কাজ করেছিল। স্ত্রী পরিচয় দেওয়া ওই নারীকে তিনি চেনেন না। ওই সময় ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছিল বলেও দাবি তার।
এদিকে, জেসমিনের বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে এনামুল হক বলেছেন, মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে তার নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলেছিলেন জেসমিন ও তার সহযোগীরা। ওই আইডিতে সরকারি কাজ বাস্তবায়নের সময় তোলা তার (এনামুল) ছবি শেয়ার করছিলেন তারা। ১৯ মার্চ রাজশাহী মহানগরের রাজপাড়ায় তার কার্যালয়ের সামনে চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যও তিনি পেয়েছেন। এসব অর্থ জেসমিন নিজের ব্যাংক হিসাব এবং মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার হিসাবে লেনদেন করতেন বলেও জানতে পেরেছেন। এতে তার (এনামুল) সম্মানহানি হয়েছে।
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, দাপ্তরিক কাজে নওগাঁয় যাওয়ার সময় তিনি গত বুধবার সোয়া ১১টার দিকে নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র্যাবের একটি টহল দলকে বিষয়টি জানান। ওই দলের ইনচার্জ ডিএডি মো. মাসুদ বিস্তারিত শুনে জানান, এ ধরনের অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় পড়ে। পরে র্যাব কর্মকর্তারা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সুলতানা জেসমিনের অবস্থান শনাক্ত করেন। এনামুল হককে সঙ্গে নিয়ে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে ১১টা ৫০ মিনিটে জেসমিনকে আটক করে র্যাবের দলটি। তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রতারণার বিষয়টি র্যাবের কাছে স্বীকার করেন। তার মোবাইল ফোনেও এসব প্রতারণার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদের একটা পর্যায়ে জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মামলা করতে বিলম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জেসমিন অসুস্থ হওয়ায় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা ও শারীরিক অবস্থার পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে তিনি স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে র্যাবের সহযোগিতায় থানায় এজাহার করেন।
তবে জেসমিন এমন কাজ করতে পারেন-তা বিশ্বাস করতে পারছেন না তার অফিসের সহকর্মীরা। নওগাঁ সদরের চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তা মোমেনা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জেসমিনকে একজন ভালো সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। অতীতেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ আমার জানা মতে হয়নি। জেসমিন শান্তশিষ্ট মানুষ ছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় অবাকই হয়েছি।’
নওগাঁ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সুলতানা জেসমিন এক বছর ধরে আমার অধীনে কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ শুনিনি।’
যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী র্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার জেসমিনকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘র্যাব আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করে। জেসমিনকে নির্যাতন করার কোনো কারণ নেই। কারণ, তিনি যে প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত তা প্রমাণ হয়েছে আগেই। তিনি তা স্বীকারও করেছিলেন।’