থেমে নেই হেফাজতে মৃত্যু

Slider বাংলার মুখোমুখি

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা কমে যায়। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই এ ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের সাবেক-বর্তমান সাত শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এরপর কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে তথা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অলিখিত লাগাম টানা হলেও থেমে নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা। ২০২২ সালে ক্রসফায়ারে চারজনের মৃত্যু হয় আর র‌্যাব-পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হয় ১৫ জনের।

নওগাঁ সদরের ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে তার মৃত্যুর বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এ কা-ের জেরে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে স্বাধীন কমিশনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে এ পর্যন্ত একটি ঘটনার বিচার হয়েছে। ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার মিরপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে দুই ভাই ইশতিয়াক হোসেন জনি ও ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে আটক করে পুলিশ। পরে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় বড় ভাই জনির। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলার রায়ে পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদ-সহ এক লাখ টাকা

করে জরিমানা এবং দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। গত ১০ বছরে এ আইনে আর কোনো শাস্তির নজির নেই।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পর চাপে পড়ে ক্রসফায়ার কমেছে। মেজর সিনহা হত্যার পরও ক্রসফায়ার কমেছিল। দেশি-বিদেশি চাপে এটি কমলেও হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে। একটি কমলে আরেকটি বাড়ে। মৌলিক অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, এসব কাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হয় না। সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। তাই অপরাধীদের মজ্জাগত ধারণা এসেছে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচার-বহির্ভূতভাবে এবং তাদের হেফাজতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের হাতে ১৩ এবং র‌্যাবের হাতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। র‌্যাবের ক্রসফায়ারে ৪ জন নিহত হয়েছে। সংস্থাটির হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। পুলিশের হেফাজতে ৭ জনের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে বলে আসক বলছে। দুজন আত্মহত্যা করেছে। ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৬৫ জন। তাদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ২৮, বিচারাধীন ৩৭ জন।

নূর খান বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। কারাগারে মৃত্যুর একটি অংশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। এটাও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের কারণেই হচ্ছে।

তথ্যমতে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহা মো. রাশেদের হত্যার পর প্রায় পাঁচ মাস দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ ছিল। এ ঘটনার পর ওই বছর বন্দুকযুদ্ধের একটিমাত্র ঘটনা ঘটে ২ আগস্ট সিলেটে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, মেজর সিনহা নিহত হওয়ার আগে ওই বছরেরই প্রথম সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ার বন্ধ ছিল। এরপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিন ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ফলে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার ইচ্ছা করলে ক্রসফায়ার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু তথা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারে এবং চালুও রাখতে পারে।

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে স্বাধীন একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার কমে যাওয়া প্রমাণ করে, চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ করতে পারে। এসব কাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে ভবিষ্যতে বিচার-বহির্ভূত হত্যার পথ বন্ধ হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ হেফাজতে যখন কেউ থাকেন তখন তার সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের। থানা হাজতে আসামি থাকলে ২৪ ঘণ্টা কমপক্ষে দুজন পুলিশ সদস্যকে পাহারায় থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হলে তার স্বাধীন তদন্ত দরকার। হেফাজতে কেউ আত্মহত্যা করলেও তার দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এড়াতে পারে না।

কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নওগাঁর (সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু) ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি কাজ করছে। যেহেতু একটি অভিযোগ এসেছে যে, আমাদের হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান সেহেতু আমরা সোমবার একটি তদন্ত কমিটি করেছি। এখানে আমাদের সদস্যদের গাফিলতি রয়েছে কি না বা অনৈতিক কিছু ঘটেছে কি না, আমরা সেটা তদন্ত করছি। গাফিলতি পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আদালতও আমাদের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন। সেগুলো আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতকে জানাব।

মুঠোফোনে বিটকয়েন দিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগে গত ৭ জানুয়ারি রাতে চারজনকে আটক করে গাজীপুরের বাসন থানার পুলিশ। পরদিন তিনজনকে ছেড়ে দিলেও ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামকে থানায় আটকে রাখা হয়। রাতে বাসন থানার এসআই নুরুল ইসলাম ও মাহবুবসহ একদল পুলিশ ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে আসেন। পরে পরিবারের লোকজন জানতে পারেন, রবিউল মারা গেছেন। শুরুতে পুলিশ ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও বিক্ষুব্ধ লোকজন সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানালে পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। নিহতের স্বজনের অভিযোগ, পরিবার অভিযোগ করেছে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিল পুলিশ। পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট রাজধানীর হাতিরঝিল থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় সুমন শেখ (২৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়।

এদিকে নওগাঁয় আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এক বিবৃতিতে হেফাজতে মৃত্যু মারাত্মক অপরাধ এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত ব্যক্তির পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক মর্মে প্রতীয়মান হয়, যা যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে।

কমিশনের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, হেফাজতে মৃত্যুসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি র‌্যাব নয়, পুলিশের অন্য কোনো ইউনিটের মাধ্যমে তদন্ত করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *