দেশের গ্রাম আদালতকে সক্রিয় করতেও এখন বিরাট অর্থ ব্যয় হচ্ছে পরামর্শক খাতে। প্রতি মাসে শুধু দুই ধরনের পরামর্শকের পেছনে খরচ হবে গড়ে দুই কোটি ৪৬ লাখ টাকা। মোট খরচ এই খাতে পাঁচ বছরে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। আর তৃতীয় পর্যায়ে এই আদালত প্রকল্পে বিদেশ সফরেই একজনের জন্য ব্যয় ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। কেনা হবে সাড়ে ৪০০টি মোটরসাইকেল। বিদেশী অনুদানসহ মোট ৪২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি অনুমোদন দিয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলছে, দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্র, প্রান্তিক ও অসহায় জনগোষ্ঠীর আইনের প্রতিকার প্রাপ্তির যথাযথ সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে গ্রামীণ পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় বিরোধ নিষ্পত্তির সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পল্লী এলাকার নারী, দরিদ্র এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয়ভাবে দ্রুত ও স্বল্প খরচে বিরোধ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতার অভাবে গ্রাম আদালত আইনটির সুবিধা গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী পরিপূর্ণভাবে পাচ্ছে না। এ আইনের পরিপূর্ণ সুবিধা ও গ্রাম জার্নালের কার্যক্রমকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে আইনের সুশাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকার স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপির আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত কার্যকর করা শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালে প্রথম পর্যায়ে দেশের ৩৫১টি ইউনিয়নে এবং ২০১৬-২২ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশের এক হাজার ৮০টি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত সেবা বাস্তবায়ন করেছে।
প্রকল্পের বিশেষ সাফল্যের কারণে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও সমীক্ষায় এ প্রকল্পকে স্থানীয়ভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিতকরণের একটি সফল মডেল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সারা দেশে এই মডেল বাস্তবায়নের পরামর্শ প্রদান করেছে। প্রকল্পের সাফল্য এবং মডেলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কারণে উন্নয়ন অংশীদাররা প্রকল্পটি দেশব্যাপী বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইআরডির মধ্যে গত ২০২২ সালের ২৭ জুন দেশব্যাপী গ্রাম আদালত সক্রিয়করণে আর্থিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ ছাড়া গত ২০২২ সালের ১৮ মে ইউএনডিপি কর্তৃক সচিব, ইআরডি বরাবর প্রেরিত পরে উক্ত প্রকল্পে ৩০ লাখ ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে।
প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে গ্রাম আদালত কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ তার কম সময়ে ও খরচে বিচারিক সেবা পাবে। উচ্চ আদালতে মামলার চাপ হ্রাস পাবে। যা ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজি ১৬:৩ এর লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। তা ছাড়া প্রকল্পটি সারা দেশে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে বিচারিক সেবা প্রদানে ও সেবা গ্রহণে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। উল্লেখ্য, গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের অল্প সময়ে, স্বল্প খরচে বিচারিক সেবা নিশ্চিতকরণ ও উচ্চ আদালতে মামলার জট কমানোর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে গ্রাম আদালত কার্যক্রমের ওপর অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে এবং ২০১৭ ও ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সারা দেশে গ্রাম আদালত কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তৃতীয় পর্যায়ের এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যার মধ্যে ২৬৮ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বা তিন কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার দেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারকে অর্থায়ন করতে হবে।
জানা গেছে, গ্রাম আদালতে বিচার্য বিষয়গুলোর মধ্যে ৬ ধরনের দেওয়ানি এবং ২৭ ধরনের ফৌজদারি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকার কর্তৃক উক্ত আদালতে বিরোধের আর্থিক সীমা ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচার্য বিষয়গুলো হচ্ছে- চুক্তি মোতাবেক অর্থ আদায়, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, গবাদিপশু অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ আদায়, স্বেচ্ছায় আঘাত করার প্রতিকার, চুরির প্রতিকার, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নারীর প্রতি অসম্মান প্রতিরোধে বিচারসহ অন্যান্য ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তি করা।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমসমূহ, সারা দেশের স্থানীয় পর্যায়ে সভা বা সেমিনার বা কনফারেন্স-৩২ হাজার ৩১৯টি, প্রশিক্ষণ ৭ হাজার ৫৩৫টি ও ১০টি শিক্ষামূলক অডিও ভিডিও নির্মাণ ও বিতরণ। বিভিন্ন ফরম, ফরম্যাট, সাইনবোর্ড ইত্যাদি মুদ্রণ ও বাঁধাইপূর্বক সরবরাহ, কনসালটেন্সি (সিএসও/এনজিও)-৪৮ মাস, পরামর্শক সেবা (ব্যক্তি) সংগ্রহ (আন্তর্জাতিক পরামর্শক-৬ জনমাস এবং দেশীয় পরামর্শক ৩২১ জনমাস)। এজলাস ও আসবাবপত্র রুম, সরবরাহ তিন হাজার ৯১৫টি এবং মেরামত এক হাজার ৪১৬টি, মোটরযান ক্রয় (জিপ-১টি ও মোটরসাইকেল ৪৫০টি)।
প্রকল্প এলাকা হলো, সারা দেশে চার হাজার ৪৫৭টি ইউনিয়ন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়িত এক হাজার ৪১৬টি ইউনিয়নে রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম এবং তিন হাজার ৪১টি ইউনিয়নে প্রথমবারের মতো কার্যক্রম শুরু হবে।
ব্যয় পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, মোট প্রকল্পের ব্যয় হলো ৪২৬ কোটি টাকা। যার মধ্যে পরামর্শক খাতেই খরচ ১২৫ কোটি টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে এই ব্যয় নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু কাজে আসেনি। এখান ব্যক্তি পরামর্শক খাতে ৩২৭ জন মাসে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৭৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। যেখানে প্রতি মাসে প্রতি জনে ব্যয় দুই লাখ টাকার বেশি। আর ফার্ম পরামর্শক ৪৮ মাসের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১১৭ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এখানে প্রতি মাসে ব্যয় হবে দুই কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আবার গ্রাম আদালতের কার্যক্রম শিখতে বিদেশ যাবেন একজন কর্মকর্তা। যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ বলছে, প্রকল্পের মূল প্রস্তাবে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫১৫ কোটি ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। যেখানে জিওবি থেকে ২৪৬ কোটি ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপির প্রকল্প অনুদান ২৬৮ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ছিল। পিইসি সভায় ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা কর্তৃক প্রতিশ্রুত প্রকল্প অনুদানের পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে জিওবি অংশের অর্থ ৮৯ কোটি ২১ লাখ টাকা কমিয়ে ১৫৪ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। অনুমোদনের কারণ হলো, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র, নারী, অনগ্রসর এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিচারব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি পাবে এবং উচ্চ আদালতে মামলার জট হ্রাস পাবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় বিচারিক সেবা পৌঁছানোর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হবে মর্মে পরিকল্পনা কমিশন মনে করে।