রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুল পঠিত ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’। কাদম্বিনী নামের এক বিধবা বৃদ্ধাকে নিয়ে আবর্তিত এ গল্পে দেখা যায়, পরিবার ও গায়ের লোকজন জানে, তিনি মারা গেছেন। আদতে তা নয়। বিষয়টি কাউকে বোঝাতেও পারছেন না এই বৃদ্ধা; যেখানেই যান, সবাই ভাবে এ নিশ্বয়ই কাদম্বিনীর ভূত। শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হন কাদম্বিনী। মরিয়া প্রমাণ করেন যে, তিনি মরেন নাই।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের কামারকুমুল্লী গ্রামের জয়গন বেগমের অবস্থাও হয়েছে কাদম্বিনীর মতো। ৬৫ বছর বয়সী এই বৃদ্ধা বিধবা ভাতা উঠাতে গেলে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে তাকে জানানো হয়, ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তার জাতীয় পরিচয়পত্রে তিনি মৃত। পরে নির্বাচন অফিসে খোঁজখবর নিলে জানতে পারেন হালনাগাদ ভোটার তালিকায় তাকে মৃত দেখানো হয়েছে। সেই থেকে এই বিধবা নারীর বিধবা ভাতা বন্ধ রয়েছে।
শুধু জয়গনই নন, গোপালপুর উপজেলায় নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় বিপুলসংখ্যক জীবিত মানুষকে মৃত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নানা কাজে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। তারা এ ধরনের ভুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। জানা গেছে, ইতোমধ্যে ২৭ জন মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়েছেন। আরও ২০৩ জনের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে!
জয়গনের নাতি রুমা (২৫) আক্তার বলেন, নির্বাচন অফিস থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। পরে আলমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সঙ্গে যোগাযোগ করে তার কাছ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে দাদিকে সশরীরে নির্বাচন অফিসে গিয়ে প্রমাণ করেন তিনি জীবিত আছেন।
আলমনগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রুহুল আমীন বলেন, নির্বাচন অফিস থেকে যারা ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা দায়িত্ব অবহেলা করেছেন।
আলমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মোমেন জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদের তথ্যে ভুলের বিষয়টি আমি জানি। নির্বাচন অফিস থেকে ডেটাবেজে ভুল করেছে। ভুক্তভোগীদের জাতীয় পরিচয়পত্রে এমন ভুলগুলো সংশোধনে সহযোগিতা করছি।
গোপালপুর পৌরসভার মেয়র মো. রকিবুল হক সানা বলেন, যাদের ভোটার তালিকায় মৃত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারা পৌরসভায় যোগাযোগ করলে আমরা ঠিক করে দিচ্ছি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা সবাই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেন তারা। তাদের কাজের নিয়মাবলি শিখিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। জীবিতদের মৃত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ২০০৭-২০২২ সাল থেকে উপজেলায় ২৭ জন ব্যক্তিকে মৃত দেখানো হয়েছে। যাদের জীবিত অবস্থায় তথ্য হালনাগাদে মৃত দেখানো হয়েছে, তারা জীবিত ফরমে আবেদন করলে সেগুলো সংশোধন করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ২০২২ সালের তথ্য হালনাগাদে আরও ২০৩ জনের তথ্যে মৃত উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সংশোধনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। অনুমতি পেলে এদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসফিয়া সিরাত বলেন, বিষয়টি জেনেছি এবং নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা মিলে মোট সংখ্যা ২ লাখ ২৭ হাজার ২৩৫। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১৪ হাজার ২২ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ১৩ হাজার ৭১২ জন।