মাসুদ রানা সরকার, বগুড়া জেলা প্রতিনিধি:মা ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। বাবা মারা যান আড়াই বছর বয়সে। তার বেড়ে ওঠা এতিমাখায়। পড়াশোনাও সেখান থেকেই। পুলিশে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হওয়ার খবরে খুশিতে কেঁদে ফেলেন।
বলছি ইউসুফ আলীর কথা। বিভিন্ন পরীক্ষা শেষে গত রোববার, ১৯ মার্চ রাতে বগুড়া পুলিশ লাইন্স অডিটরিয়ামে পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেন। সেখানে তার নাম শুনেই কেঁদে ওঠেন ইউসুফ।
১৯ বছর বয়সী তরুণ ইউসুফ আলী জীবনের ১৪ বছরই কাটিয়েছেন জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবারের এতিমখানায়। বাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নে। বাবা মৃত হাসেন আলী। মা দোলেনা বেওয়া। ফেরি করে কখনো কাপড় বিক্রি করতেন গ্রামেগঞ্জে। কখনোবা চাতাল শ্রমিকের কাজ করতেন।
ইউসুফের বাবা পেশায় ছিলেন দিনমজুর। তার বয়স যখন মাত্র আড়াই বছর বাবাকে হারান তিনি। পরিবারে অভাব অনটন থাকায় ছয় বছর বয়সেই ইউসুকে তার মা রেখে আসেন জয়পুরহাটের এতিমখানায়। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি।
জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবার থেকে ইউসুফ ২০১৯ সালে ৪ দশমিক ২৮ জিপিএ পেয়ে মাধ্যমিক ও ২০২১ সালে ৪ দশমিক ৪২ জিপিএ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। বর্তমানে তিনি জয়পুরহাট সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন।
পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগের খবর পেয়ে দরখাস্ত করেন ইউসুফ। পরীক্ষা শেষে গত রোববার পুলিশে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন।
সীমাহীন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা এই তরুণের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। ইউসুফ বলেন, ‘বাবা দিনমজুর ছিলেন। নিজেদের কোন বাড়িঘর নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর মাথা গোঁজার জন্য আশ্রয় নিতে হয় নানার বাড়িতে। এরপর মা গ্রামেগঞ্জে কাপড় ফেরি করে বিক্রি করতেন। কখনও আবার চাতাল শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছেন।
‘আমার দুই ভাই। বড় ভাই ইসমাইল আকন্দও ২০১৯ সালে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেট্রোপলেটিন পুলিশে কর্মরত আছেন। ভাইয়ের চাকরির পরেই মাকে আর কাজ করতে হয়নি। এখনতো আর কখন-ই মাকে কাজ করতে হবেনা। সৃষ্টিকর্তার কাছে থেকে বাবাও আমাদের জন্য অবশ্যয় অনেক খুশি হয়েছেন। আর মায়ের খুশি আর আনন্দ দেখে কে।’
তিনি বলেন, ‘মা প্রথম ২০০৭ সালে ভাইকে এরপর ২০০৮ সালে আমাকে জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবার এতিমখানায় রেখে আসেন। সেখানেই জীবনের বেড়ে উঠার সব সময় পার করেছি। শিশু পরিবারের শিক্ষকরা অনেক অনেক আন্তরিক। নিজেদের সন্তানদের মতো করেই আমাদের মানুষ করেন। শুধু শিক্ষকরাই নয় ওখানে থাকা বড় ভাইরাও অনেক বেশি সহায়ক। ছোটতে তারাই আমাদের গোসল করিয়ে দিতেন। কাপড় ধুয়ে দিতেন। বড় হওয়ার পর আমিও চেষ্টা করেছি ঠিক একইভাবে ছোটদের সহায়তা করার।’
‘জীবনের সবচেয়ে বেশ্রি অনুপ্রেরণা পেয়েছি আমার মা ও ভাইয়ের থেকে। কখনও তারা আমাকে কষ্ট পেতে দেয়নি। শতকষ্টের মাঝে বুকে আগলে রেখেছেন তারা। সত্যিকার জীবনের হিরো আমার জন্য মা ও ভাই।’
ইউসুফ আরও বলেন, ‘আমি জয়পুরহাট জেলা দলের হয়ে ফুটবল খেলেছি। ইচ্ছে আছে বাংলাদেশ পুলিশের হয়ে জাতীয় দলে ফুটবল খেলবো। পাশাপাশি সুযোগ পেলে জয়পুরহাট কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করতে চাই।’
চাকরি পাওয়ার পরের দিনই জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবার যান ইউসুফ। সেখানে থাকা সব ছোটরা তার নিজের ভাই ও পরিবার। সবাই অনেক খুশি হয়েছে। এখনোতো চাকরি শুরু হয়নি। তাই ওদের জন্য কিছু নিয়ে যেতে পারেনি ইউসুফ। তবে জীবনের প্রথম বেতন মা, ভাই ও শিশু পরিবারে সদস্যদের জন্যই বরাদ্দ রাখতে চান তিনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সামর্থ্য অনুযায়ী এতিমদের জন্য কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ইউসুফ।
ইউসুফ বলেন, ‘চাকরির জন্য টাকা দেওয়ার কোনো সামর্থ্য নেই। মাত্র ১২০ টাকা খরচ করে চাকরি পাওয়াটা গল্পের মতোই। তাই চাকরি পাওয়ার ঘোষণায় আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। চেষ্টা করব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার।’
গত ডিসেম্ব মাসে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বগুড়া জেলায় ১২৯ পদের বিপরীতে এ পদের জন্য আবেদন করেন ৪ হাজার ৫১৫ নারী-পুরুষ। প্রাথমিক বাছাই শেষে ২ হাজার ৮৩০ পুরুষ এবং ৪৮৭ জন নারীসহ ৩ হাজার ৩১৭ জনকে শারীরিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। ২ মার্চ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বিভিন্ন ধাপে বাছাই শেষে ৯ মার্চ লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ৯৬৬ জন পুরুষ, ১২৬ জন নারীসহ মোট ১ হাজার ৯২ জন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ২৯২ জন পুরুষ এবং ৩৫ জন নারী। রোববার (১৯ মার্চ) রাত ১০ টার দিকে শুরু হয় ৩২৭ জনের মৌখিক পরীক্ষা। রাত ১১টার দিকে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত ১১০ জন পুরুষ এবং ১৯ জন নারীর নাম ঘোষণা করা হয়। পরে নির্বাচিতদের ফুল দিয়ে বরণ করার পাশাপাশি মিষ্টিমুখ করায় বগুড়া জেলা পুলিশ।
বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। যে কারণে লিখিত পরীক্ষায় একজন প্রার্থীও অনুপস্থিত ছিলেন না। গত বছর নিয়োগে আবেদনকারী ছিলেন ৩ হাজার ৬০ জন। মানুষের আস্থা বেড়ে যাওয়ায় এবার প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৫১৫জন