গ্রামীণফোনের আপসের প্রস্তাব নাকচ সরকারের

Slider তথ্যপ্রযুক্তি


গ্রামীণফোনের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) অডিট আপত্তির পাওনা সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা এখনো অনাদায় রয়ে গেছে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের দুই দফা নির্দেশে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করলেও বাকি টাকা পরিশোধের বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। গত জানুয়ারিতে গ্রামীণফোন বিআরটিসিকে আপসের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে বিটিআরসির সর্বশেষ নিয়মিত কমিশন সভায় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়।

২০১৯ সালের শুরুতে যখন বিটিআরসি পাওনা দাবি করে, তখন এটাকে অন্যায্য ও অযৌক্তিক বলে দাবি করেছিল অপারেটরটি। এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের আদালতে যাওয়ার পাশাপাশি অপারেটরটি তাদের বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানিতে যাওয়ার বিষয়ে একটি নোটিশও সরকারকে পাঠিয়েছিল। এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও ‘উকিল নোটিশ’ পাঠানোর মতো কাজ করেছিল অপারেটরটির মূল কোম্পানি টেলিনর।

চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি গ্রামীণফোন বিটিআরসিকে চিঠি দেয় এই অডিট আপত্তির ‘মধ্যস্থতা’ নিয়ে আলোচনার জন্য। এর দুই মাস আগে অপারেটরটি ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ (প্রথম) আদালতে আবেদন করে, বিটিআরসির সঙ্গে মধ্যস্থতার জন্য তাদের আরও সময় প্রয়োজন। গ্রামীণফোন প্রথমে এই আদালতেই সরকারের অডিট আপত্তির পাওনার চিঠি স্থগিতের আবেদন করেছিল, যা এখনো বিচারাধীন রয়েছে।

নীতিনির্ধারক ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসলে কত সময় প্রয়োজন? অপারেটরটির দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করার পর বাকি পাওনা নিয়ে মধ্যস্থতা করতেই তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেল!

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আমাদের সময়কে বলেন, ‘যখনই রাষ্ট্রের কোনো পাওনা দাবির কথা আসে, তখন নানা অজুহাত দেখিয়ে দুই ধরনের চেষ্টা দেখা যায়। একটি হলো বিলম্ব করা, আরেকটি হলেঅ পাওনা কমানো যায় কিনা। দেনদরবার ও তদবির হতে শুরু করে এমন কোনো চাপ নেই যে তারা দেয় না। অডিটের পাওনা টাকা যখন আদায় করি, তখন কল্পনার বাইরে তারা চাপ দিয়েছে। কিন্তু আমরা আইনের বাইরে যেতে পারি না। ওরা যখন নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করার চেষ্টা করে কিংবা আদালতে যায়, তখন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে হয়। তবে আমরা সরকারি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চুল পরিমাণ ছাড় দেইনি, দেবও না’।

অন্যদিকে, গ্রামীণফোনের মধ্যস্থতার আবেদনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিটিআরসি সাড়া দেয়নি। গ্রামীণফোন বলছে, তাদের মামলায় সিপিসি ৮৯ ধারায় আপসের বিধান আছে। কিন্তু বিটিআরসি বলছে, গ্রামীণফোন ওই ধারার বিধান অনুযায়ী তাদের কাছে আবেদনই করেনি। তাই মধ্যস্থতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিটিআরসি। তবে গ্রামীণফোন সূত্রে জানা গেছে, তারা এবার সিপিসি ৮৯ ধারার বিধান অনুযায়ী আবেদন করবে। এখন এর প্রস্তুতি চলছে।

গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস খায়রুল বাশার আমাদের সময়কে বলেন, গ্রামীণফোন বরাবরই গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী। বিটিআরসির ইস্যুকৃত অডিটসংক্রান্ত দাবিটি বর্তমানে বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনে (দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮-এর ধারা ৮৯ ক) বিচারাধীন বিষয়ে পক্ষদের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। সেই অনুযায়ী গ্রামীণফোন অডিট বিরোধটির একটি স্বচ্ছ ও সৌহার্দপূর্ণ সমাধানকল্পে বিটিআরসির সঙ্গে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনসিদ্ধ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।’

এদিকে গ্রামীণফোনের আবেদনে এই অডিট পাওনা ইস্যু মধ্যস্থতার জন্য ২০২৩ সালের ২২ জুন তারিখ ধার্য রেখেছেন ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ (প্রথম) আদালত।

দেশে গ্রামীণফোনের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অডিট করে বিটিআরসি। বেসরকারি অডিটদের করা ওই নিরীক্ষায় অপারেটরটির কাছে ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা কমিশনের পাওনা বলে উঠে আসে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ওই টাকা দাবি করে কমিশন অপারেটরটিকে চিঠি দেয়। এরপর গ্রামীণফোন দাবি করে, তাদের কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে টাকা নিতে চাইছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও বিটিআরসি অপারেটরটির এই বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে।

অডিটে সরকারের সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনার তথ্য বেরিয়ে এলে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এর মধ্যে ব্যান্ডউইডথ কমিয়ে দেওয়া এবং ২২ জুলাই থেকে অপারেটরটি যাতে আর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন সেবা নিয়ে আসতে না পারে, সে জন্য তাদের সব অনুমোদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০১৯ সালের ২ এপ্রিল অডিট আপত্তির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ করার জন্য চিঠি দেয় বিটিআরসি। তবে ওই পাওনা দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে গ্রামীণফোন নিম্ন আদালতে একটি মামলা করে ও পাওনা দাবির অর্থ আদায়ের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চায়। ওই বছরের ২৮ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ (প্রথম) আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর বিরুদ্ধে গ্রামীণফোনের পক্ষে গত ১৬ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়। এর গ্রহণযোগ্যতার শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন এবং ওই অর্থ আদায়ের ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে বিটিআরসি আবেদন করে, যা চেম্বার বিচারপতির আদালত হয়ে আপিল বিভাগে শুনানির জন্য যায়।

পরে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর আপিল বিভাগ গ্রামীণফোনকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দাবি করা ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, নির্ধারিত সময় তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করতে পারলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে বিটিআরসি।

এরপর এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি রিভিউ আবেদন করে অপারেটরটি। এতে তারা ৫৭৫ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে, যা তারা এক বছরে সমান বারোটি কিস্তিতে পরিশোধ করতে চাইছিল। তবে আবেদনে ওই প্রস্তাব আমলে নেয়নি উচ্চ আদালত। পরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই রিভিউ আবেদনের শুনানি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত গ্রামীণফোনকে বলেন, আগে বিটিআরসিকে ১০০০ কোটি টাকা দিয়ে আসুন, এরপর পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে।

এরপর ওই বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসিকে ১০০০ কোটি টাকা দেয় গ্রামীণফোন। এর একদিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদনের রায়ে আপিল বিভাগ গ্রামীণফোনকে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে বিটিআরসিকে আরও এক হাজার কোটি টাকা দিতে বলেন। এরপর গ্রামীণফোন ওই এক হাজার কোটি টাকাও পরিশোধ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *