আর কিছু দিন পরই রহমত ও বরকতের মহান বার্তা নিয়ে পশ্চিমাকাশে পবিত্র রমজানের চাঁদ উদিত হবে। অকল্পনীয় রহমত লাভের নৈসর্গিক মুহূর্তরাজির বার্তাবাহি চাঁদ দেখে মুমিনের হৃদয় আনন্দে হিল্লোলিত হবে। জান্নাতের দ্বার উন্মোচিত হবে। জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ধিকৃত শয়তান শৃঙ্খলিত হবে। চার দিকে সিয়াম সাধনার আলোকোদ্ভাসিত এক নূরানী পরিবেশ বিরাজ করবে। সারা দিন উপোস অনাহারে থাকার পর ইফতারের পূর্বমুহূর্তে সবাই সমবেত হওয়া, ক্ষমা ও রহমত লাভের আশায় দু’হাত তুলে রবের কাছে আরজি পেশ করা- এ এক অন্যরকম ভালোলাগার মুহূর্ত। এ যেন জান্নাতি মিলনমেলারই এক নয়ন জুড়ানো দৃশ্য।
রমজানের প্রস্তুতি: বস্তুত মুমিন হৃদয়ে রমজান প্রাপ্তির অঙ্কুরোদগম হয় রজবের স্নিগ্ধ একফালি বাঁকা চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকেই। তারা পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কারণ তারা জানেন, কোনো বিষয়ে সফলতা আনতে চাইলে অথবা কোনো বিষয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করলে তার প্রথম ধাপই হচ্ছে নিজের মন-মানসিকতা স্থির করা এবং তার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকা। তাই রজব থেকেই তারা রমজান প্রাপ্তির স্বপ্ন দেখতে থাকেন আর লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাখেন, কিভাবে অতিবাহিত করবেন এই মোবারক মাসের বরকতপূর্ণ সময়গুলোকে।
রমজানকে কাজে লাগাতে কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ-
তাওবা করে নেয়া : একনিষ্ঠ তাওবা করা। মুমিন যেহেতু এক মহান মাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই নিজের কৃত পাপগুলোর জন্য অনুতপ্ত হৃদয়ে একনিষ্ঠভাবে তাওবা করে নেয়া এবং অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণেœর যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো আদায় করে দেয়া কিংবা ক্ষমা চেয়ে নেয়া। যাতে সে পূতঃপবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয়ে এ মোবারক মাসে প্রবেশ করতে পারে এবং আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতে পারে। কুরআন-হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে মুমিনগণ তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে করে সফলকাম হতে পারো’ (সূরা আন-নূর, আয়াত-৩১)।
ইবনে ইয়াসার রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘হে লোকেরা, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো। আমি প্রতিদিন তার কাছে শতবার তাওবা করি’ (মুসলিম, হাদিস-২৭০২)।
মানসিক প্রস্তুতি : কোনো কাজের জন্য প্রথমে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। নিয়তে গরমিল থাকায় অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজও পড়ে থাকে অবহেলায়। তাই মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি দৃঢ়তার সাথে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে, প্রতিদিন কুরআনের কত পারা করে পড়তে চাই, কুরআনের কতটুকু মুখস্থ করা আমার পক্ষে সম্ভব, প্রতিদিন কত ঘণ্টা সহিহ কুরআন শিক্ষায় সময় দেয়া যাবে, হাদিসের কিতাব কতটুকু তালিম করা হবে ইত্যাদি।
শারীরিক প্রস্তুতি : শারীরিক প্রস্তুতি হিসেবে বেশি বেশি নফল নামাজ, নফল রোজা রাখা যেতে পারে। কেননা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে রমজানে রোজা রাখতে, তারাবিহ পড়তে আর কষ্ট হবে না। শাবান মাস এলেই নবী কারিম সা: বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তেন, নফল রোজা রাখতেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, নবী সা: পুরো শাবান মাস রোজা রেখেছেন (ফাতহুল বারি-২৫২)।
পূর্বের কাজা রোজা আদায় করে নেয়া : কোনো ওয়াজিব রোজা নিজ দায়িত্বে থাকলে তা থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া। আবু সালামা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি আয়েশা রা:-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার ওপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে শাবান ছাড়া আমি তা আদায় করতে পারতাম না’ (বুখারি-১৮৪৯)।
মালিক-শ্রমিকদের জন্য করণীয় : শ্রমিকরা তো সারা বছরই কাজ করে। রমজানেও নিশ্চয় কাজ ছাড়ার ফুরসত থাকবে না। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলামের দিকনির্দেশনা হচ্ছে- রমজানে কোনো ভারী কাজ না করা। রমজানের আগেই খরচের জন্য অতিরিক্ত কিছু সঞ্চয় করে রাখা। মালিকদের জন্য দিকনির্দেশনা হচ্ছে- শ্রমিকদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা। রমজান মাসে তাদের ওপর কষ্টকর সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপিয়ে না দেয়া। এটি অমানবিকও বটে। কারণ তারাও মানুষ, তাদেরও কষ্ট আছে। মানুষ হিসেবে মানুষের কষ্ট লাঘব করা- এটিই মানবতা। অতিরিক্ত কষ্ট চাপিয়ে দেয়া এটি অমানবিকতা।
ব্যবসায়ীদের জন্য করণীয় : অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমজানে মানুষ একটু বেশি বাজারমুখী হয়। ব্যবসার প্রতিটি সেক্টরে তখন ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেপরোয়া হয়ে যান। তারা খাদ্য গুদামজাত করে বাজারে সঙ্কট তৈরি করে, ফলে দ্রব্যসামগ্রীর দাম আকাশ স্পর্শ করে। আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের রমজানের বাজার হয়ে ওঠে এক অভিশাপের নাম। ইসলাম ব্যবসায়ীদের এসব গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে, দিয়েছে কঠোর সতর্কবার্তাও। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যারা মজুদদারি করে, তারা অভিশপ্ত। আর যারা মানুষের পণ্য সহজভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় তারা রহমতপ্রাপ্ত’ (কানযুল উম্মাল)।
রমজান পাওয়ার জন্য দোয়া করা : আল্লাহ তায়ালার কাছে বিনীতভাবে এই দোয়া করা যে, তিনি যেন শারীরিকভাবে সুস্থ রেখে উত্তম দ্বীনদারির সাথে রমজান পর্যন্ত হায়াত দেন, নেক আমলের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন এবং আমলগুলো কবুল করেন। কিছু কিছু সালাফ থেকে বর্ণিত আছে- তারা ছয় মাস আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যেন আল্লাহ তাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। রমজানের পর পাঁচ মাস দোয়া করতেন, যেন আল্লাহ তায়ালা আমলগুলো কবুল করে নেন।