সে দিন মার্কেটে যাওয়ার পথে উত্তরার হাউজ বিল্ডিংয়ের রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা একটি আর্ট গ্যালারিতে আঁকা ছবিতে চোখ পড়লে থমকে দাঁড়ালাম। ছবির ক্যাপশন দেখে চোখ কপালে উঠল। শাড়িতে পেঁচানো অর্ধনগ্ন একটি নারী দেহের ছবি। নারীর পিঠের অধিকাংশই খোলা। আর এই ছবির নাম ‘মুক্তি’। আমি বিস্মিত হলাম! অর্ধনগ্ন একজন নারীর জন্য মুক্তি কিভাবে হতে পারে? এটি কি আদৌ নারীর স্বাধীনতা বা মুক্তি আনতে পারে?
আমি ছবি দেখে মনে মনে হাসতে লাগলাম। নারী দেহের ওপেননেসের মধ্যে যারা নারীর স্বাধীনতা খুঁজে, তারা আসলে কতটাই বোকা! অর্ধনগ্ন নারীর দেহকে হয়তো মানুষের সামনে ওপেন বা মুক্ত করে দেয়, কিন্তু তার সত্তাটাকে কতটা পরাধীন করে দেয় তা একজন বুঝমান নারী ছাড়া আর কে বুঝে!
নারীর স্বাধীনতা কিসে? তা জানার আগে আমরা স্বাধীনতার সংজ্ঞা জেনে নেই। স্বাধীনতা বলতে আসলে কী বোঝায়?
ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে ফ্রিডম বা স্বাধীতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-
‘নিয়ন্ত্রিত বা সীমিত না হয়ে কোনো কিছু করতে সক্ষম হওয়া বা কোনো কিছু করা, বলা, চিন্তা করার অনুমতি পাওয়ার অবস্থা বা অধিকারই হচ্ছে স্বাধীনতা।’
আর এই স্বাধীনতার অর্থ জানার পাশাপাশি আমরা অধিকারের সংজ্ঞা জানার চেষ্টা করি। অধিকার বলতে আসলে কী বুঝি?
ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে অধিকার বা ‘রাইট’-এর এমন সংজ্ঞা আছে Considered fair or morally acceptable by most people
অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে Right-এর সংজ্ঞা হচ্ছে- Something morally good.
অতএব অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে উল্লিখিত মুক্তি ও অধিকারের সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি, ‘নৈতিকভাবে ভালো এবং সমাজের বেশির ভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো কিছু করা, বলা বা চিন্তা করার অনুমতি পাওয়ার নাম হচ্ছে স্বাধীনতা।’
একটি মেয়ে অর্ধনগ্ন হয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ালে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ কি একে ভালোভাবে গ্রহণ করে? মেয়ে মানুষ কেন, একজন পুরুষের অর্ধনগ্নতাও কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে না। পাশ্চাত্য সমাজে নারীর অর্ধনগ্নতাকে সহজভাবে দেখা হলেও আমাদের সমাজে এটিকে এখনো কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করে না। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে না সেটি আর যাই হোক কারো অধিকার হতে পারে না। আমরা একে স্বেচ্ছাচারিতা বা অসচেতনতা বলতে পারি। আর কোনো জিনিস যদি কারো অধিকার না হয়ে থাকে তাহলে সেটি অর্জন করার, বলার বা করার অনুমতি লাভের নাম আর যাই হোক কখনো ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে না।
নারী যদি নিজের দেহকে ঢেকে রাখে তবে তার স্বাধীনতা হরণ হয় না; বরং তার মর্যাদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন (প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সময়) তাদের (পরিহিত) জিলবাবের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে, ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আহজাব-৫৯)।
সূরা নূরে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া অন্য কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো’ (সূরা নূর-৩১)।
বিশ্বনবী সা: বলেন, ‘নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু, যখনই সে পর্দাহীনভাবে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে উঁকি মেরে তাকায়’ (তিরমিজি-১১৭৩)।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আহজাবে বলেছেন, পর্দা করা নারীদেরকে আলাদা করে চেনা যাবে এবং তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। যদিও আমাদের সমাজে পঙ্কিলতার সয়লাবের কারণে অনেক হিজাবধারী মেয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার কিছুটা হলেও খোলামেলা মেয়ের তুলনায় অনেক কম হয়।
মেয়েরা নিজেদের শরীরকে অন্যের সামনে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করলে বা বেশি সাজগোজ করলে তাদের স্বাধীনতা বাড়ে না। একটি মেয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারবে অন্যের প্রশংসা পাওয়ার জন্য তাদের মন এত উদগ্রীব হয়ে উঠে যে তারা মনের অজান্তে নিজের জন্য না সেজে রাস্তার অচেনা, অজানা বা অল্প চেনা মানুষের জন্য সাজগোজ করতে থাকে। লোকের চোখে তাকে কেমন দেখাবে এমন একটি মানসিক চাপ তাকে কুরে কুরে খায়।
মানুষ কি বলবে? আমাকে দেখতে কেমন লাগবে? আমাকে খোলা চুলে না বাঁধা চুলে ভালো লাগবে? আমাকে হালকা মেকআপ না গাঢ় মেকআপে ভালো লাগবে? আমাকে লাল শাড়ি না নীল থ্রি-পিসে ভালো লাগবে? এমন চিন্তা, আর এই চিন্তার আলোকে নেয়া নানা পদক্ষেপ; বরং তাকে স্বাধীনতার সুখ উপভোগ করতে দেয় না। তার দেহটিকে মানুষ ও প্রকৃতির সামনে খোলামেলা বা স্বাধীন করলেও তার সত্তাটিকে বরং অন্যের চিন্তাধারার কাছে বন্দী করে ফেলে। আর এভাবে সে তার প্রকৃত স্বাধীনতাটিই হরিয়ে ফেলে।
হাফিংটন পোস্টে ২০১৭ সালে প্রকাশিত গাব্বে আসেইয়ের আর্টিকেল Muslims are the true feminists-এ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমেরিকান সমাজে নারীকে এমনভাবে দেখা হয় নারী মানেই শারীরিক মোহ প্রদর্শন করে থাকবে, লম্বা চুল রাখবে, মুখের নিখুঁত সৌন্দর্য থাকবে, অসাধারণ দেহাবয়ব থাকবে। আর যখন এসব প্রদর্শনের স্বাধীনতা আমাদের নারীরা অর্জন করে থাকে তখন আমরা ভাবি যে, নারী হিসেবে আমরা স্বাধীন। আমাদের চারপাশে যেসব লোক আছে তাদের চোখে আমাদের কেমন দেখাচ্ছে এসব বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তায় মশগুল থাকার মাধ্যমে আমরা মূলত প্রাকৃতিক নারীত্বকে নষ্ট ও দমন করার চেষ্টা করছি। সমাজের সব সমালোচনা উপেক্ষা করে আমাদের এটি বলার সাহস নেই যে- ‘আমার দেহ প্রদর্শনের জন্য নয়’।
কিন্তু আমি অনেক মুসলিম নারীকে দেখেছি তারা এই সৎ সাহস অর্জন করার চেষ্টা করেছে। এভাবে তারা প্রতিদিনের অযথা বাহ্যিক চাপ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের এটি বলার সৎসাহস আছে যে- ‘আমি কোনো আনন্দের সামগ্রী নই, আমি একজন নারী। আমি কেমন দেখাচ্ছি তার ভিত্তিতে নয়; আমি আসলে কী এর ভিত্তিতে আমাকে সম্মান ও মূল্যায়ন করা উচিত।’
নিজেদের স্বাধীন করার এমন সাহস আমেরিকান সংস্কৃতি থেকে তাদেরকে আলদাভাবে উপস্থাপন করেছে। প্রদর্শনের বাহানায় নারীরা যেসব চাপের মধ্যে থাকে সেই চাপ থেকে নিজেদেরকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন করার শক্তি মুসলিম নারীদের রয়েছে। তারা কখনো দেহ প্রদর্শনের কাজে মনোযোগ দেয় না; বরং কিভাবে নিজের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা উপস্থাপন করা যায় সে দিকে মনোযোগ দেয়। তারা সৌন্দর্য চর্চার পূজারী নয়। এর ফলে মুসলিম নারীরা সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জন করে থাকে এবং তাদের কমিউনিটিতে তাদের বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়।’
আমার মনে হয় নারী যদি তার দেহ প্রদর্শনের ইচ্ছা থেকে দূরে সরে গিয়ে তার মেধা, মননের বিকাশে মন দেয় তাহলেই তারা প্রকৃত স্বাধীনতা বা মুক্তি অর্জন করতে পারবে।
গাব্বে আসেই তার Muslims are the true feminists আর্টিকেলের শেষের দিকে এভাবে বলে তার লেখার ইতি টেনেছেন- আমি অবশেষে বুঝতে পারলাম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কারা স্বাধীন ও কারা নির্যাতিত। নির্যাতিত মূলত আমরাই আমেরিকান নারীরা, মুসলিম নারীরা নয়। যে নারীরা হিজাব পরে তারা মূলত পুরুষ এবং সমাজের নারীর দেহ দর্শনের মাধ্যমে বিবেচনা করার দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে। বস্তুবাদী নারীবাদীরা যা পারেনি তারা তা পেরেছে।’
শারমিন আকতার
লেখক : সম্পাদক, মহীয়সী এবং ব্যাংকার