বাংলাদেশে এক দিন আগের দামের হিসাব করে বাজারে গেলে পরের দিন পণ্য কম কিনতে হবে বা কোনো পণ্য কেনার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কারণ প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। এখন দৌড়াচ্ছে ব্রয়লার মুরগির দামের পাগলা ঘোড়া।
এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ১১০ টাকা। এক মাস আগে ১৬০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ২৭০ টাকা। আর শবেবরাতের আগের দিন গরুর গোশতও এক লাফে কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। ১৩ থেকে ১৪ দিন পর রোজা শুরু হবে। তাই এখনই যে দামের এই ঊর্ধ্বগতি থামবে তা বলা যায় না। রোজা শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এটা একটা নতুন কৌশল। আগে রোজার সময় বাড়ত। এবার রোজা শুরুর এক মাস আগেই তারা বড়িয়ে দিয়েছেন। গরুর গোশত অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে কেজি ৮০০ টাকা ছুঁয়েছে।
সরকার বিদ্যুতের দাম দু‘মাসে তিন বার বাড়িয়েছে। গ্যাসের দাম বড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। দাম বাড়ার এই চতুর্মুখী চাপে সাধারণ মানুষ এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কোনোভাবেই আয়-ব্যয় মিলছে না। তাই মানুষ এখন কম কিনছেন, কম খাচ্ছেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নাজমুল হক তপন বলেন,‘ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে আমরা যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এরইমধ্যে পুরোপুরি স্মার্ট হয়ে গেছেন। তারা রোজার এক মাস আগেই নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে রোজার সময় আর বাড়াতে হবে না। দাম বাড়ানের পিকে চলে গেছেন তারা। ফলে রোজায় যদি দুই-একটি পণ্যের দাম কমেও যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এটা তাদের কৌশল।’
তিনি আরো জানান,‘গত এক মাসে সব ধরনের পণ্যের দাম গড়ে ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। এতদিন কম খেয়ে, কম কিনে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন সেভাবেও পারছি না৷ তাই এমাসে বাসা পরিবর্তন করে কম ভাড়ায় ছোট বাসায় উঠেছি। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে হয়তো গ্রামে চলে যেতে হবে। সেখানে তো আর বাসা ভাড়া লাগবে না। মূলত আমরা যারা অল্প আয়ের মানুষ তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।’
তিনি জানান, সবচেয়ে কম দামের মাছ তেলাপিয়ার কেজিও একমাসে ৫০ ভাগ বেড়ে ২৫০ টাকা কেজি হয়েছে।
এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ব্রয়লার মুরগির দাম হু হু করে বাড়ছে। রোজার আগে ব্রয়লার মুরগির বাজরে এই পরিস্থিতি কেন? এর জবাবে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘এর জন্য দায়ী কর্পোরেট সিন্ডিকেট। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা। একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ডিম, মুরগির বাজারের ২০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে এককভাবে। আমরা শত শত ছোটে খামারিরা তাদের কাছে অসহায়। দাম বাড়লেও তা আমরা পাই না। কারণ আমরা সরাসরি বাজারে দেই না। ব্যবসা লুটে নেয় কর্পোরেটরা।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন। বাজারে যে কর্পোরেট কোম্পানির ২০ ভাগ শেয়ার আছে তারাই প্রতিদিন ছয় কোটি, মাসে ১৮০ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা লুটেছে। তারা ডিম মুরগির বাচ্চা সব কিছুতেই সিন্ডিকেট করে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘দেশে উৎপাদিত এবং আমদানি করা সব ধরনের ভোগ্যপণ্যই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। আমরা সেটা বার বার বলেছি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের চিহ্নিতও করেছে; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট, পেঁয়াজের সিন্ডিকেট, চালের সিন্ডিকেট সব কিছুই খোলা। বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেল আর জ্বালানি তেল দুটির দামই কমেছে। কিন্তু এখানে কমেনি। সরকারের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সাধারণ মানুষকে চাপে রেখে ব্যবসা করছে। আর সিন্ডিকেটগুলো সরকারের ছত্রছায়ায় সাধারণ মানুষের গলা কাটছে।’
তার কথা, ‘১০ টাকার সাবান ১৫ টাকা হয়েছে; কিন্তু কাঁচামালের দাম তো ৫০ ভাগ বাড়েনি। এই যে ব্রয়লার মুরগি, ডিমের দাম হু হু করে বাড়ল বাজারে তো কোনো সাপ্লাই সঙ্কট হয়নি। তাহলে কেন এ বাড়তি দাম? সরকার কি এটা দেখেছে?’
তিনি আরো জানান, ‘কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা একটা নতুন কৌশল নিয়েছে। রোজার এক-দেড়মাস আগেই ভোগ্যপণ্যের দাম সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দেয়। হয়ত রোজার সময় সরকারে অনুরোধে কিছুটা কমিয়েও দেবে। এটা সরকারও জানে। সরকারের রেগুলেটরি বডিগুলো তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সরকার জনবান্ধব নয়, ব্যবসাবান্ধব হয়েছে।’
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চার-পাঁচটি কারণে পণ্যের দাম বাড়তে পরে। ১. আমদানি করা পণ্যের দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ে। ২. ডলারের অবমূল্যায়ন হলে যদি আমদানি পণ্যে তার প্রভাব পড়ে। ৩. দেশের ভেতরে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ যদি বাড়ে। ৪. দেশের ভেতরে বাজারে যদি কোনো দুষ্কৃতি থাকে এবং ৫. সরকার বাজার প্রভাবিত করতে যে কার্যক্রম নেয় যেমন, টিসিবির মাধ্যমে পণ্য দেয়া সেগুলো যদি ঠিকমত কাজ না করে।
ভোজ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ার পরও এখানে কমছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই একটি বিষয় দিয়ে পুরোটা ব্যাখ্যা করা যাবে না। বাজারের ভেতরে সমস্যা আছে। স্বচ্ছতার অভাব আছে। তথ্য উপাত্ত নিয়ে বাজারে নজরদারির সঙ্কট আছে। সরকার তো আমদানি করা পণ্যের দাম জানে। তাহলে দাম বেশি নেয় কীভাবে? মূলত এই সময়ে সরকারের বাজারের ওপরে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রভাব খুবই দুর্বল।’
তিনি এখনকার বাজার ব্যবস্থাকে বিকৃত বাজার ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘এই বিকৃতি বাজার ব্যবস্থার কাছে ক্রেতারা এখন অসহায় অবস্থায় আছে।’
তবে ব্যবসায়ীদের কথা আলাদা। এখন তারা ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের কথা বলছেন। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক পরিচালক মো: হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, ‘মুরগি ও ডিমের দাম এখনই ঠিক আছে। আগে কম ছিল। চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হত। এখন উৎপাদন কমে দাম সঠিক পর্যায়ে এসেছে। আগে খামারিদের লোকসান হতো। আর রমজানের পণ্য ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর ও সয়াবিন তেলের আমদানি কম।’
কিন্তু জানুয়ারি মাসে ব্যবসায়ীরা ডলার সঙ্কটে এলসি না খুলতে পারার কথা বললেও বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ উদ্যোগ নেয়ায় ওই সঙ্কট কেটে যায়। তারপরও অজুহাত শেষ হয় না। হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, ‘দেশে ব্যবসায়ীদের কোনো সিন্ডিকেট নাই। থাকলে সরকার তাদের ধরুক। আমরা বাধা দেব না। বাজারের দাম বাজারই ঠিক করে, আমাদের সেখানে কিছু করার নাই।’
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘শুধু ভোক্তা অধিদফতর তো এককভাবে বাজার ঠিক করতে পারব না। এখানে আরো অনেকের দায়িত্ব আছে। তবে রমজানে যাতে কেউ বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে না পারে, সরবরাহে যাতে কোনো সঙ্কট তৈরি না হয় সেটা মনিটরিং-এ জোর দিচ্ছি। এই মনিটরিং-এ আমরা এবার বাজার কমিটিকে অন্তর্ভুক্ত করছি। যাতে তাদেরও দায়ের মধ্যে আনা যায়। কোনো বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিলে তাদেরও দায় নিতে হবে।’
তিনি আরো জানান, গত একমাস ধরে তারা বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের সাথে বৈঠক করেছেন। তাতে বেশ কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে। সেগুলো ঠিক করছেন। কেউ যাতে প্রতারণা করতে না পারে, বেশি দাম নিতে না পারে ও মজুত করতে না পারে অভিযান শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগির বাজারে তারা অভিযানে জোর দিয়েছেন। আর ভোজ্য তেলের বাজার এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে দাবি করেন তিনি।
সূত্র : ডয়চে ভেলে