ঢাকা: পরপর দুটি ‘নিষ্ফল’ আন্দোলন এবং কূটনৈতিক লবিং থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত না হওয়ায় বিএনপির সবস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা।
মাঠ থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত এখন এই হতাশা বিরাজ করছে। তৃণমূলে আরো বেশি সংক্রমিত হয়েছে বিষয়টি। সেই সঙ্গে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদস্যদের কথাবার্তাতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে হতাশার সুর।
দলীয় সূত্র জানায়, সরকারকে ‘চূড়ান্ত ধাক্কা’ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূতির দিন অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবগুলো পন্থা উপেক্ষা করে নজিরবিহীন ‘নাশকতা’ চালানোর ফলে বিএনপি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে ৩ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের ‘নিষ্ফল`’ আন্দোলন শেষে ৫ এপ্রিল খালি গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে খালি হাতে ঘরে ফেরেন খালেদা জিয়া।
সূত্রটি জানায়, পর পর দুটি ব্যর্থ আন্দোলন ও দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া খালি হাতে ঘরে ফেরার পর সরকার হটিয়ে ক্ষমতারোহণের স্বপ্ন ভেঙে যায় বিএনপির। তৃণমূল থেকে শুরু করে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, নির্ধারিত সময়ের আগে মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচন আদায় করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সভাপতি মোজাহার হোসেন টেলিফোনে বলেন, অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে গণতন্ত্র না থাকলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। খুব সহজে আলোর সন্ধান পাচ্ছি না আমরা।
ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তৈমুর রহমান টেলিফোনে বলেন, ক্ষমতাসীনরা বিএনপিকে যেভাবে বিপর্যস্ত করেছে, তাতে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। তবে এটিকে টাইম ফ্রেমে বাঁধা যাবে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হলেই সরকার পিছু হটতে বাধ্য হবে।
এদিকে, দুটি ‘নিষ্ফল’ আন্দোলনের পর বিএনপির সর্বশেষ ভরসা ছিল কূটনৈতিক লবিংয়ের। দলটির নেতারা ভরসায় ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চলতি বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফরে এসে চলমান সংকটের একটা সুরাহা করে যাবেন।
কিন্তু সদ্য সমাপ্ত মোদির সফর থেকে নিজেদের জন্য তেমন কোনো অর্জন দেখছেন না বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। জোর তদবির চালিয়ে ঘণ্টা খানেকের বৈঠক-ই মোদির সফর থেকে বিএনপির একমাত্র অর্জন।
খালেদা জিয়ার লিখিত ‘নালিশ’ কর্ণপাত না করা এবং জনভাষণ ও যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো কথা না থাকায় যারপরনাই হতাশ বিএনপি নেতৃত্ব।
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি সরকারকে কোনো বার্তা দিয়ে গেছেন কিনা, তা জানার জন্য অপেক্ষায় ছিল বিএনপি। কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ইঙ্গিত না পাওয়ায় পুরনো ‘ফরমেট’-এ ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি।
ফলে মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর প্রথম সাতদিন চুপ থাকলেও রোববার (১৪ জুন) গুলশান অফিসে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় খালেদা জিয়া বলেন ‘দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আমরা কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই না’।
তার বক্তব্যের পর বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিএনপির যে প্রত্যাশা ছিল, সেটি পূরণ হয়নি। সে হতাশা থেকেই দলটির চেয়ারপার্সন তার পুরনো অবস্থানে ফিরে গেছেন। নেতাকর্মীরাও ফিরেছেন ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থানে।
দলীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সংলাপ ও আগাম নির্বাচনে সরকারকে রাজি করানোর একটি পরিকল্পনা ছিল বিএনপির।
কি্ন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্রের অবৈধ চালান এবং বর্ধমান বিস্ফোরণে জামায়াত-বিএনপির সম্পৃক্ততা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির তিন প্রশ্নে খালেদা জিয়ার বিব্রত হওয়ার খবর দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর বিএনপির স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, মোদি-খালেদার একান্ত বৈঠকের আলাপচারিতা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় বোঝা গেছে, বিএনপির ব্যাপারে মোদির অবস্থান ভারতের অন্য সরকারের অবস্থান থেকে আলাদা নয়।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবর রহমান বলেন, মোদি-খালেদার একান্ত বৈঠকের আলোচনা সংবাদমাধ্যমে আসার কথা না। আলাপচারিতা কাউকে জানানো হবে না বলেই তারা একান্ত বৈঠক করেছেন। তারপরও যেহেতু তাদের আলাপচারিতা সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সেহেতু ধরে নিতে হবে কেউ না কেউ তা মিডিয়াকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, তবে এটুকু বলতে পারি, খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে মিডিয়াকে কিছু বলা হয়নি।
এদিকে, বিএনপির শীর্ষ নেতারা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দিকে তাকিয়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরে তার কোনো খবর মিলছে না।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও তারানকোর ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ‘দ্রুত’ আরেকটি নির্বাচনের ব্যাপারে যে মৌখিক প্রতিশ্রুতি এসেছিল, সেটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে তারানকোর সফর প্রয়োজন। তিনি এলেই চলমান সংকটের সমাধান খুঁজে পাবে বিএনপি।
কিন্তু তারানকোর বাংলাদেশ সফরের কোনো সম্ভাবনা না দেখে দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাহবুবর রহমান বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তারানকোর উপস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা হয়েছিল। যেভাবেই হোক, শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। তিনি আবার এলে এসব বিষয় নিয়ে হয়ত আবার কথা উঠতো।