আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে কোনো মামলার তদন্তকালে আসামি গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। এমনকি এজাহার দায়েরের আগেও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সুযোগ রয়েছে। বিগত সময়ে এমন গ্রেপ্তারের বহু নজিরও আছে। কিন্তু গত এক থেকে দেড় বছর ধরে এ থেকে সরে এসেছে দুদকের বর্তমান প্রশাসন। এ ছাড়া হাতেনাতে দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও কমে গেছে।
দুদকের দায়িত্বশীলরা বলছেন, কমিশন কথায় কথায় কাউকে গ্রেপ্তারের পক্ষে না। কোনো আসামি বা অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কেউ যদি দেশত্যাগ করতে চায়, সে ক্ষেত্রে তাকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ করা হবে। তবে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত এক জেলা জজের মতে, দুদকের মামলায় সব আসামি গ্রেপ্তারযোগ্য। মামলার পর কাউকে গ্রেপ্তার না করা হলে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জানা গেছে, বর্তমানে কমিশনে অনুসন্ধান ও তদন্তনাধীন পর্যায়ে রয়েছে প্রায় ছয় হাজার অভিযোগ ও মামলা। এসবে গ্রেপ্তারযোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ক্ষমতা থাকলেও গত বছর (২০২২) মাত্র তিন থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী বার্ষিক প্রতিবেদনে গ্রেপ্তারের তথ্য রাখা হচ্ছে না বলে আমাদের সময়কে নিশ্চিত করেছেন কমিশনের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
দুদক আইন ২০০৪-এর ২০(৩) ধারা অনুসারে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আইনের তফসিলভুক্ত অনুসন্ধান বা তদন্ত বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) কর্মকর্তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। এ ছাড়া দুদক আইনের ২১ ধারায় গ্রেপ্তারের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধানাধীন কোনো অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিংবা মামলার আসামিকে গ্রেপ্তারের আগে কমিশনের পূর্বানুমতি লাগবে। কিন্তু বর্তমান কমিশন আসামি গ্রেপ্তারে অনেকটাই নিরুৎসাহিত করছে। যে কারণে আগের কমিশনের মত আসামি গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৭ সালে দুদক প্রধান কার্যালয়ে হাজতখানা গড়ে তোলে সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। পাশাপাশি আসামি গ্রেপ্তারে সহযোগিতা পেতে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ২০ সদস্যের সশস্ত্র একটি পুলিশ ইউনিট দুদকে যুক্ত করা হয়। কিন্তু এখন আসামি গ্রেপ্তার না থাকায় দুদকের সেই হাজতখানা বেশির ভাগ সময় খালি পড়ে থাকে। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যরা দুদকের ব্যারাকে থাকলেও তাদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
দুদকের গত ছয় বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ১৮২ জন, ২০১৮ সালে ৫৭, ২০১৯ সালে ১২৩, ২০২০ সালে ২৯ জন এবং ২০২১ সালে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করে দুদক।
এ ছাড়া এক সময়ে দুদক প্রতিবছর ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার করত। আসামি গ্রেপ্তারের মতো এ ধরনের গ্রেপ্তারের পরিমাণও কমে গেছে। ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তারের বিষয়ে দুদক থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে ২৪ জন, ২০১৮ সালে ১৫, ২০১৯ সালে ১৬ এবং ২০২০ সালে ১৮ জনকে ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২১ সালে ৬ জন ও ২০২২ সালে ৪ জনকে ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তার করেছে দুদক।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন) ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম জানান, দুর্নীতিসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে সবই আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত এবং দুদকের মামলার সব আসামিই গ্রেপ্তারযোগ্য। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুদক দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে অভিযোগ নিশ্চিত হয়ে মামলা করে। যাকে আসামি করা হচ্ছে, তাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করার মতো উপাদান আছে। যেসব প্রমাণ পেয়ে দুদকের মামলা করে, তার পর কেবল চার্জশিট লেখা বাকি থাকে। সেই আসামিকে গ্রেপ্তার না করার কোনো কারণ থাকার কথা না। আসামি গ্রেপ্তার না হলে দুদকের তদন্তেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটি খারাপ দৃষ্টান্ত। এতে করে দুদকের দুর্নীতি দূর করার যে কাজ তা পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে।’
আসামি গ্রেপ্তার না হলে দুদক আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন মঈদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এই আসামি যখন হাইকোর্টে জামিনের জন্য যায় তখন দুদক থেকে সেখানে একজন আইনজীবী নিয়োগ করতে হয়। সেখানে অহেতুক অর্থ খরচ হয়। আসামি গ্রেপ্তার হলে সোজা দায়রা জজ আদালতে চলে যেত।’
দুদকের আইনগত কিছু সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, দুর্নীতির বর্তমান অবস্থা চিন্তা করে দুদককে নতুন আঙ্গিকে সাজানো দরকার। কারণ ২০০৪ সালে যে ধরনের দুর্নীতির কথা চিন্তা করে আইনটি করা হয়েছিল, বর্তমানে তা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দুর্নীতির পরিধি, এরিয়া ও দুর্নীতিবাজের সংখ্যাও বেড়েছে।’
দুদকে আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তদন্তের কথা বিবেচনা করে আসামি গ্রেপ্তার করা হবে কিনা তা বিবেচিত হয়। গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন কিনা তা তদন্ত কর্মকর্তাই ভালো বুঝবেন। তিনি যদি মনে করেন কোনো আসামি তদন্ত কার্যক্রমের প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করা দরকার, তিনি সেটিই করবেন।’
দুদকের মামলায় গ্রেপ্তারের প্রয়োজন পড়ে কিনা- এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করা হয়। আমরা বিনা প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করি না। কাউকে যদি গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে যদি বিচারে প্রমাণ হয় তিনি নির্দোষ তা হলে তার অবস্থা কী হতে পারে সেই বিষয়টি দেখতে হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘যখন-তখন যে কাউকে একটা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা যায়। পরে তিনি আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কথায় কথায় আমরা গ্রেপ্তারের পক্ষে না। বরং কেউ যদি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তা হলে তার বিষয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়ে রাখি যাতে যেতে না পারেন। তখন সেই ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবগুলো ফ্রিজ করা হয়। এর পর তাকে গ্রেপ্তারও করি।’