চাপে পড়ে নিজের গ্যাস খুঁজতে তৎপর সরকার

Slider সারাবিশ্ব


দেশে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস কূপগুলো থেকে প্রতিনিয়ত উৎপাদন হ্রাস এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতার কারণে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান বাড়াতে তৎপর জ্বালানি বিভাগ। যদিও দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে গত এক দশক ধরেই কাজ চলছে। তবে এর গতি অনেকটা শ্লথ ছিল। কিন্তু ২০১৯ সাল-পরবর্তী কোভিড এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি খাত গভীর সংকটে পড়ে যাওয়ায় এখন জোড়ালো তৎপরতা চলছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কোনো বিকল্প নেই। স্থলভাগে

অনুসন্ধানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকা গভীর সমুদ্রে জোড়ালোভাবে অনুসন্ধান চালাতে চায় জ¦ালানি বিভাগ। ফলে বিদেশিদের জন্য আর্কষণীয় উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। অনেকটা নানামুখী চাপে পড়ে নিজের গ্যাস খুঁজতে মরিয়া সরকার।

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, মার্কিন খ্যাতিমান কোম্পানি এক্সন মোবিল সমুদ্রে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। জ্বালানি বিভাগে লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছে কোম্পানিটি। এ ছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে দেখা করে মার্কিন কোম্পানির আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

২০১৫ সালের দিকেও দেশীয় কূপগুলো থেকে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে এখন দৈনিক দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ২২শ থেকে ২৩শ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে। অথচ গত ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে গ্যাসের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। শিল্প কারখানাগুলো গ্যাসের জন্য হাহাকার করছে। সরকার বিদেশ থেকে লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম অনেক বেশি হওয়ায় খরচ বাঁচাতে এলএনজি আমদানিতে লাগাম টেনে ধরেছে সরকার। প্রায় ৮ মাস এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছিল। এ সময় প্রচ- গ্যাস সংকট দৃশ্যমান হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমার দিকে থাকায় এখন আবার স্পট মার্কেট থেকে আমদানি শুরু হয়েছে। তবে আর্থিক সংকটে এলএনজি আমদানি কতদিন অব্যাহত রাখা যাবে সেটা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

এই অবস্থায় সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে গত কয়েক মাসে জ্বালানি বিভাগ এবং বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) দেশীয় গ্যাস উৎপাদনে আগ্রাসী পদক্ষেপের চেষ্টা করছে। এ জন্য শুধু স্থলভাগে অনুসন্ধানই নয়, গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে টেন্ডার আহ্বানের প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। নতুন পিএসসি সংশোধন চূড়ান্ত হলেই টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বিদেশি কোম্পানিগুলো যাতে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়, সেই ধরনের পিএসসি তৈরি করা হচ্ছে। নতুন পিএসসিতে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে ওঠানামা করবে। পেট্রোবাংলার কর্তকর্তারা জানান, নতুন পিএসসি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য রয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলেই বাকি কার্যক্রম শুরু করা হবে।

জ¦ালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্থলভাগে গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জ্বালানি বিভাগ। বিশেষ করে পেট্রোবাংলা স্থলভাগে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের মাধ্যমে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৬২ কোটি ঘনফুট বৃদ্ধি করতে চায়। এর মধ্যে ১৭ অনুসন্ধান, ১২ উন্নয়ন এবং ১৭টি ওয়ার্কওভার (সংস্কার) কূপ খনন করা হবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (সরকারের অতিরিক্ত সচিব) জনেন্দ্র নাথ সরকার আমাদের সময়কে জানান, দেশের গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ৪৬টি কূপ খনন করে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করবে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আকর্ষণীয় পিএসসি তৈরির কাজ চলছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।

সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলা ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৪৬টি কূপ খননের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলো দেশীয় গ্যাস কোম্পানির ক্ষেত্রগুলোতে খনন করা হবে। বাপেক্স তাদের গ্যাসক্ষেত্রে ৫টি আর সিলেট গ্যাসফিল্ডস কোম্পানির (এসজিএফএল) কোম্পানির ফিল্ডে ১টি কূপ খননের কাজ করছে। চলতি বছরের মধ্যে বাপেক্সের ৫টি, এসজিএফএলের ৬টি এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির (বিজিএফসিএল) ৪টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এই ১৫ কূপে দৈনিক ২১.৭ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধির আশা করছে পেট্রোবাংলা। আগামী বছর (২০২৪) বাপেক্স ৬, বিজিএফসিএল ৪ এবং এসজিএফএল ৪ কূপ খনন করতে পারে। এতে ওই বছর দিনে ১৭.৬ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। ২০২৫ সালে বাপেক্স ৪, বিজিএফসিএল ৪ এবং সিলেট গ্যাস ৩টি কূপ খনন করবে। এতে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ১৬ দশমিক ৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়তে পারে।

এর বাইরে বিদেশি কোম্পানির শেভরন বিবিয়ানার অনাবিষ্কৃত অংশে একটি অনুসন্ধানী কূপ খননের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছে। এ ছাড়া ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসির চলতি বছর অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর দুটো অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা রয়েছে। সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপ চীনের কোম্পানি সিনোপ্যাকের খনন করার কথা রয়েছে। বাপেক্সের শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব-১ কূপ খননের প্রস্তুতি চলছে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে একটি অনুসন্ধান এবং একটি উন্নয়ন ও ৫ ওয়ার্কওভার কূপের মাধ্যমে ৩-৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়েছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে সিলেট ৯ নম্বর কূপে নতুন গ্যাস মিলেছে। এখান থেকে ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মিলছে। ফেঞ্চুগঞ্জ ৩ ও ৪নং কূপে ওয়ার্কওভারে ১.৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। কৈলাসটিলা ৭ কূপ থেকে ১ কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। শ্রীকাইল ৪ নম্বর কূপ থেকে ২ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ভোলায় একটি কূপ থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।

এদিকে গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, বিদ্যমান ক্ষেত্রের মজুত ও নতুন স্তরে গ্যাস অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ কার্যক্রম চালাচ্ছে বাপেক্স। বর্তমানে ব্লক ১৫ ও ২২-এর আওতাধীন ফেনী ও চট্টগ্রামে টুডি সাইসমিক সার্ভের কাজ চলছে। নভেম্বরে ব্লক ৬বি ও ১০-এর আওতায় বরিশাল-চাঁদপুর অঞ্চলে গ্যাসের খোঁজে টুডি ভূকম্পন জরিপ চলবে। সিলেটের জকিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের পাথারিয়ায় চলতি বছর ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ কার্যক্রম চালাবে বাপেক্স।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র নতুন কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বছর অনুসারে পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাতে সারা বছর কাজ হবে।

বর্তমানে দেশে ২১টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। দেশীয় তিনটি কোম্পানরি ১৭টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৮৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস। বিদেশি দুই কোম্পানি শেভরন ও তাল্লোর মালিকানাধীন চার গ্যাসক্ষেত্র থেকে মিলছে ১৪৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর বাইরে আমদানি করা এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৫৩ কোটি ঘনফুট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *