করোনা মহামারীর পর হজ পালনের ওপর আরোপ করা সব বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে সৌদি সরকার। এবার সব বয়সের মানুষদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে হজ পালন; কিন্তু এবার সরকারি এবং বেসরকারি দুই পর্যায়েই বেড়েছে হজের খরচ।
গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে হজের খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। বাড়তি খরচের কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই হজযাত্রা থেকে বিরত থাকছেন। এর প্রমাণ মিলেছে হজের নিবন্ধনে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যেতে পারবেন। কাক্সিক্ষত হজযাত্রী না পাওয়ায় দুই দফা বাড়ানো হয়েছে নিবন্ধন প্রক্রিয়া। এর পরও মিলছে না চাহিদা অনুযায়ী হজযাত্রী।
বর্তমানে হজে যেতে হলে প্রথম ধাপে প্রাক-নিবন্ধন করতে হয়। সারাবছরই এই প্রাক-নিবন্ধন করা যায়, যেটি সম্পন্ন করলে একটি নম্বর দেওয়া হয়। ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সেই নম্বর হজের জন্য নির্বাচিত হলে তা এসএমএস ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। কেবল নির্বাচিত হলেই নিবন্ধন সম্পন্ন করা যায়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন সিস্টেমের হিসাব অনুযায়ী চলতি ২০২৩ সালে হজে যেতে ইচ্ছুক হিসেবে প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন দুই লাখ ৪৯ হাজার ২২৪ জন। এদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন আট হাজার ৩৯১ জন। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন দুই লাখ ৪০ হাজার ৮৩৩ জন। তবে এখন তাদের চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন করতে বলা হলে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
সর্বশেষ হিসাব মতে, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত হজ পোর্টাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৮১০ জন হজে যেতে নিবন্ধন করেছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮ হাজার ২৪ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৭৬০টি এজেন্সির মাধ্যমে ৩৫ হাজার ৭৮৬ জন হজযাত্রী নিবন্ধন করেছেন।
দেশে গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে হজযাত্রীদের নিবন্ধন কাজ। ২৩ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে সময় পাঁচ দিন বাড়িয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়। এর পরও কাক্সিক্ষত হজযাত্রী না পাওয়ায় ধর্ম মন্ত্রণালয় এ সময় আরও সাত দিন বাড়িয়ে আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং অবশিষ্ট ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার সুযোগ পাবেন। চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি প্যাকেজের মাধ্যমে হজ পালনের নিয়ম রাখা হয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি প্যাকেজটি ঘোষণা করে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এবার সরকারিভাবে হজ পালনে খরচ হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে এজেন্সির মাধ্যমে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। এর মধ্যে বিমানভাড়া ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া ২ লাখ ৫ হাজার টাকা, মিনার তাঁবু ভাড়া ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ভিসা ফি ৮ হাজার ৫১৭ টাকা, খাবার খরচ ৩৫ হাজার টাকা।
হজে যেতে ইচ্ছুক আশাদুল রহমান নামের একজন বলেন, ‘হজে যাওযার জন্য দুই বছর আগে নিবন্ধন করেছিলাম। তখন এত টাকা ছিল না। হজে সাধারণত মধ্যবিত্ত মানুষ বেশি যায়। খুব বড় লোক কিন্তু হজে বেশি যায় না। হঠাৎ এভাবে প্যাকেজ মূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের মধ্যে আগ্রহ অনেক কমে গেছে। এত টাকা আমার চিন্তায়ও ছিল না। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় হজে যাওয়া সম্ভব নয়।’
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ বিভাগের কর্মকতারা বলছেন, খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় হজে যেতে আগ্রহীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে কোটা পূরণে সমস্যা হবে না। নিবন্ধনের সময় বাড়ানো হয়েছে। শেষ সময়ে নিবন্ধনের চাপ বাড়বে। ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনই হজে যাবেন বলে আশা তাদের।
হজের কয়েক মাস আগে হজ এজেন্সিগুলো ব্যস্ত সময় পার করলেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। বেশিরভাগ অফিসে তেমন ব্যস্ততা নেই। এজেন্সিগুলো বলছে, যারা প্রাক-নিবন্ধন করেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। নিবন্ধনের সময় চলে যাচ্ছে, তবু তারা কেন নিবন্ধন করছেন না, এ বিষয়ে তারা প্রাক-নিবন্ধনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন; কিন্তু এ বছর খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
হজ এজেন্সির মালিকরা বলছেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রাক-নিবন্ধন করলেও অনেকে চূড়ান্ত নিবন্ধন করছেন না। ধর্ম মন্ত্রণালয় নিবন্ধনের সময় বাড়ালেও লাভ কী? খরচ যে হারে বেড়েছে তাতে যারা যাবেন না, তারা তো আর সিদ্ধান্ত বদলাবেন না। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিমানভাড়াসহ হজের খরচ পুনর্নিধারণ করা জরুরি। গত বছর হজযাত্রীদের জন্য বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ বছর তা ৫৮ হাজার বাড়িয়ে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
হজের বিমানভাড়া কমিয়ে পুনর্নিধারণ করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। ১৪ ফেব্রুয়ারি আটাব বিমানভাড়াসহ প্যাকেজ মূল্য পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
আল ইহসান নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী এনায়েত মিয়া বলেন, ‘প্রতিবছর এই সময়টাতে এজেন্সিগুলোতে হজযাত্রীদের আসা-যাওয়া লেগে থাকে। এ সময় আমরাও প্রচুর ব্যস্ত থাকি। প্রাক-নিবন্ধনকারীদের অধিকাংশই এই সময়টাতে হজে যাওয়ার জন্য নানাভাবে তদবির করেন। তবে এ বছর তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। বরং যারা প্রাক-নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলেন, তারা ওমরাহ করতে সৌদি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলছেন।’ তিনি বলেন, ২০২২ সালে হজের খরচ সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মতো ছিল। গত বছর করোনার কারণে নানা ধরনের বিধিনিষেধ ছিল। তাই খরচ অনেক বাড়তি ছিল। সবাই ভেবেছিলেন এবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় খরচ কিছুটা কমবে; কিন্তু নানা খাতে খরচ বেড়ে প্রায় সাত লাখ হওয়ায় অনেকেই হজে যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন।
এয়ার টার্চ লিমিটেড এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মাওলানা ইয়াকুব শারাফাতি আশাবাদ ব্যক্ত বলেন, ‘আমাদের থেকে যারা হজে যাওয়ার জন্য প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন তাদের অনেকেই এখন নিবন্ধন করছেন। যদিও সেটি অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম; কিন্তু আমরা প্রত্যেক বছর দেখেছি শুরুতে কমই থাকে এবং প্রত্যেক বছরই সময় বাড়ানো হয়। এটা ঠিক যে, এখনো কোটা পূরণে অনেক বাকি রয়েছে। এবারও হয়তো নিবন্ধনের সময় আরও কয়েক দফায় বৃদ্ধি করা হবে। গোটা রমজান মাস তো বাকি রয়েছে। আমার বিশ্বাস কোটা পূরণ হয়ে যাবে।’
জ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বিমানভাড়া অনেক বেশি হওয়ায় হজের খরচ বেশি। তাই নিবন্ধন তুলনামূলক কম হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘খরচ বাড়ার অন্যতম কারণ বিমানভাড়া। আমরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ভাড়া যৌক্তিক করার আহ্বান জানাচ্ছি।’