সাফল্যের আনন্দ পঞ্চম শ্রেণির কোনো শিশুর কাছে বর্ণনাতীত। আবার উল্টো হলেও তা মানিয়ে নেওয়া অনেক কঠিন। কোমলমতি এই শিশুদের বৃত্তি পরীক্ষার ফল একবার দিয়ে আবার তা স্থগিত করে নতুন ফল ঘোষণা করছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। এর মাধ্যমে শিশুদের মানসিকভাবে পিষ্ট করা হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের কোডের ক্ষেত্রে ভুল করায় ঘোষিত ফলে ভুল হয়েছে।
গত মঙ্গলবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। এমন অবস্থায় সন্ধ্যায় ফল স্থগিত করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। গতকাল বুধবার এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে জানা গেছে, কারিগরি দলের গাফিলতিতে এ ভুল হয়। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, তিন বছর ধরে না-হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলের মতো করে বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরি করতে গিয়েই সমস্যাটি হয়েছে। ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হতো উপজেলাভিত্তিক। বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরিতেও উপজেলাভিত্তিক ডেটা নিয়ে কাজ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের কোডের ক্ষেত্রে ভুল করা হয়েছে। এতে একাধিক উপজেলার কোড একই হওয়ায় সমস্যাটি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হয়তো ঝিনাইদহের একটি উপজেলার শিক্ষার্থীর যে কোড ছিল, তা হয়তো সুনামগঞ্জের কোনো উপজেলায়ও ছিল। কেন্দ্রীয়ভাবে ফল তৈরির জন্য ডেটা নিয়ে যখন কাজ করা হয়, তখন একই কোড হওয়ায় ফলেও ভুল হয়েছে। দুই কোড যখন এক হয়ে গেছে, তখন হয়তো যে শিক্ষার্থীর বৃত্তি পাওয়ার কথা নয়, সেও বৃত্তির তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে, আবার উল্টোটাও ঘটেছে। এমনকি নিবন্ধন করে পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও কেউ কেউ বৃত্তি পেয়ে গেছে। যেমন বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার পাঁচপাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছিল এক শিক্ষার্থী। কিন্তু সে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। কিন্তু তাকেও বৃত্তি (সাধারণ কোটা) পাওয়ার তালিকায় রাখা হয়েছে। এ রকম আরও ঘটনা ঘটেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, এবার পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিল। অবশ্য পরীক্ষায় অংশ নেয় ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ শিক্ষার্থী। তিনি আরও জানান, ২০২২ সালের পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ কোটায় পেয়েছে ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন। এখন সংশোধিত ফলের পর সংখ্যাটি কত হয়, সেটি জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভুলের সংখ্যাটি একেবারে কমও হবে না। এখন ফল সংশোধন করা হচ্ছে। তারা মনে করছেন, সংশোধিত ফলে বৃত্তি পাওয়া কেউ কেউ বাদ যেতে পারে।
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে শুরু থেকে ওলট-পালট হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। গণসাক্ষরতা অভিযানের এই নির্বাহী পরিচালক মনে করেন এ ঘটনায় অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর। নীতিনির্ধারকরা যখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে নেন বলে মনে হচ্ছে না। আমি বলব- আসলে এই পরীক্ষাটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পরীক্ষাটি নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
জানা গেছে, করোনার সংক্রমণ ও নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গত তিন বছর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এ পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হতো। যদিও ২০০৯ সালের আগে পৃথকভাবে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে আর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হবে না- এমনটি বলে আসছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু হঠাৎ গত ২৮ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ২০২২ সালের বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তখন ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন দেশের ২৯ বিশিষ্ট নাগরিক। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মনজুর আহমদসহ এই বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছিলেন, এর মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য ও গাইডবইয়ের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তবে সিদ্ধান্তে অনড় থাকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু আমাদের সময়কে বলেন, ‘অভিভাবক সমাজ ও শিক্ষাবিদদের আহ্বান উপেক্ষা করে এ ধরনের একটি পরীক্ষার আয়োজন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এখন যে ফল প্রকাশ হয়েছে, এতে ত্রুটি আছে তারা স্বীকারও করছে। নিশ্চয়ই এটি দায়সারা গোঁজামিল দিয়ে একটি ফল তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য দায় কার?’ কোমলমতি শিশুদের মানসিক পীড়ার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক উত্তম কুমার দাশ। তিনি জানান, এই কমিটিতে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার পাশাপাশি কারিগরি অভিজ্ঞতা থাকা আরও দুজন কর্মকর্তা রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বৃত্তি পরীক্ষা হবে ২৯ ডিসেম্বর (২০২২ সাল) এবং ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী (সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় ঠিক করবে) তাতে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরীক্ষা নেওয়া হয় ৩০ ডিসেম্বর। আর পরীক্ষা দিতে পেরেছে একেকটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতিটিতে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এ পরীক্ষা হয়।