জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনো দশ মাসের মতো। এরই মধ্যে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এ নির্বাচন। বিভিন্ন ফোরামে তারা এ প্রসঙ্গে কথা বলছেন, নিজেদের মতামত তুলে ধরছেন। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক তথা গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জানাচ্ছেন তাদের দেশের আগ্রহের কথা। একইভাবে সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও কূটনীতিকদের সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে বৈঠক করছে। প্রতিটি বৈঠকেই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বোঝার চেষ্টা করছেন, আগামী নির্বাচন কেমন হতে পারে, কোন দলের কৌশল কী হবে, ন্যূনতম কেমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে ইত্যাদি বিষয়।
আগামী সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে বেশি সরব পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে দুদিনের সফর শেষে গতকাল ঢাকা ছেড়েছেন। সফরকালে তিনি বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন। বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধি। সাক্ষাৎকালে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে তার সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। আমি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সে দিনই বিকালে ডেরেক শোলে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে- এ বিষয়ে জনগণের আস্থা আসতে হবে। জনগণ বললেই বলা যায়, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এটিই আমাদের অবাধ, মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যা। নির্বাচন বিষয়ে আমাদের প্রত্যাশার কথা আমরা সরকারকে জানাতে থাকব। সরকার থেকে বারবার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ব্যাখ্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যার অভিন্নতা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের হয়ে আমি বলতে পারব না। তবে সরকারের কাছে আমরা আমাদের অবাধ, মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে যাব। বিশ্বের যে কোনো স্থানে নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে সংলাপের বিষয়ে মত দেন মার্কিন এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বস্ত হওয়ার বিষয়ে ডেরেক শোলে বলেন, সরকার বলেছে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চায়। এ বিষয়ে আমি আশ্বস্ত। তবে সুশীল সমাজকে চাপে রাখা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা ও পূর্ববর্তী নির্বাচন নিয়ে আমাদের কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। আমরা উদ্বেগের বিষয়গুলো জানিয়ে যাব। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে এক প্রশ্নে শোলে বলেন, নির্বাচনের ফল বিরোধীপক্ষের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।
এদিকে গতকাল ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৭টি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলের। ইইউ রাষ্ট্রদূতের বাসায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়েই ছিল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সূত্র জানায়, ইইউ রাষ্ট্রদূতদের জিজ্ঞাসা ছিল, আগামী নির্বাচন অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা, নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা। জবাবে ওবায়দুল কাদের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। বৈঠকের পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইইউর সঙ্গে আজকের এ বৈঠক। ইইউর ৭টি দেশের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চায়, চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশগ্রহণ করুক।
ইইউ আগামী নির্বাচন নিয়ে যা বলছে, সে বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আপনাদের মতামত কী? এমন প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলেছি যেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার তার বক্তব্যে বলেছেন- আগামী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন কর্তৃত্ব¡পূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে নির্বাচন কমিশনকে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের বক্তব্যে কোনো ভিন্নতা নেই।
প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, আমরা তারই প্রতিধ্বনি করেছি। একই সঙ্গে আমরা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতিও নিচ্ছি।
এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সফরকালে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ওপর জোর দেন তিনি। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়েও তিনি জানার চেষ্টা করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি জানতে চান, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা এবং বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা?
গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি। তবে আগামীতে বাংলাদেশে কী ধরনের নির্বাচন হবে, তা অবশ্যই এ দেশের জনগণ নির্ধারণ করবে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়। সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এটি। সে সময় তিনি মন্তব্য করেন, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। লু জানান, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন মনিটরিং করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। তার সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তবে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় ভারত পাশে থাকবে বলে নয়াদিল্লির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তার দেশের úূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও নির্বাচন নিয়ে এ দেশে কোনো ধরনের অস্থিরতা দেখতে চায় না প্রতিবেশী দেশটি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে সদ্যবিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছিলেন, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায় ভারত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নাক গলাবে না নয়াদিল্লি। এরপর যোগ করেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে ভারতে এর প্রভাব পড়ে। তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চান।
বিদেশি কূটনীতিকদের প্রত্যাশা প্রসঙ্গে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, তাদের দেশগুলোতে সরকারের যেমন কাঠামো, তারা মনে করেন সব দেশেই সে ধরনের কাঠামো থাকা দরকার। সেই হিসেবে তাদের চাওয়াটা নতুন কিছু না। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ও গণতন্ত্রের একটা ঘাটতি যে আছে, তা অস্বীকার করা কোনোভাবেই সম্ভব না। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিদেশিরা এ ধরনের (সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন) কথা বলার পর কি সমস্যার সমাধান হবে? তাতে কি বাংলাদেশের গণতন্ত্র মজবুত হবে? ইতিহাস কখনো তা বলে না। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র যা-ই আছে বা যতটুকু পাওয়া হয়েছে, দেশের জনগণই সেটা এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশিদের চাওয়ায় বা মানুষের প্রশ্নে বাংলাদেশের গণতন্ত্র কখনো মজবুত হয়নি। আরও সমস্যা তৈরি হয়েছে। বরং গণতন্ত্রের যেটুকু রয়েছে, সেটা হয়েছে বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই।
আন্তর্জাতিক এই বিশ্লেষক বলেন, আমাদের দেশে বিভাজনের একটা রাজনীতি রয়েছে। অনেকে মনে করেন, বিদেশিরা যদি নির্বাচন ইস্যুতে কিছু বলে, তাহলে একটা চাপ তৈরি হবে। কিন্তু ইতিহাস দেখে আমার তা মনে হয় না। আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করেন তাদের চিন্তা-ভাবনার মতোই আমাদের গণতন্ত্রও তৈরি হয়। এটা নতুন কিছু না। এবারও তাই। কিছু জিনিসের ঘাটতি আছে, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন বলেন, ভোট হবে, জনগণ ভোট দেবে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে- এটিই সব দেশের নিয়ম। বিদেশিদের আগ্রহ থাকতে পারে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে। তারা তাদের অবস্থানও তুলে ধরছেন। শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালই বলেছেন, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে।