কৃষি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তদুপরি চাকরিচ্যুত। অথচ সেই কর্মচারীর সম্পদের পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে! ১৯টি ব্যাংকে তার ও তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ১২৫টি অ্যাকাউন্ট। হ্যাঁ, বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ বৈত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেলেন তিনি? উত্তরÑ প্রতারণার মাধ্যমে। শুধু প্রতারণাতেই থেমে থাকেনি তার দৌড়। ভুক্তভোগীদের কেউ টাকা ফেরত চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়ে জেলে পাঠানোর মতো অপকর্মের নজিরও রয়েছে। তার নাম আবদুল মালেক। যশোর সদরের আঞ্চলিক কৃষি অফিসের চাকরিচ্যুত এ কর্মচারী এখন লাপাত্তা।
জানা গেছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে আবদুল মালেক হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতারণার শিকার অন্তত ২৫ জনের কাছ থেকে ২ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। এ টাকায় তিনি ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, কুষ্টিয়া শহরে জাহান নামে একটি মার্কেট করেছেন এবং বিপুল পরিমাণ জমির মালিক বনে গেছেন।
পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৪ সালে যশোর জেলা সদরের আঞ্চলিক কৃষি অফিসের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে যোগ দেন। প্রতারণার বিভিন্ন অভিযোগের কারণে পরবর্তীকালে তার চাকরি চলে যায়। প্রতারণার শিকার পাবনার বেড়া উপজেলার আব্দুর রহমান গত বুধবার আমাদের সময়কে বলেন, সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন আবদুল মালেকের অ্যাম্বিশন কোচিং সেন্টারে। পরে আবদুল মালেকের প্রলোভনে পড়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে চাকরি পাওয়ার আশায় ১৪ লাখ টাকা দেন। এর মধ্যে ৮ লাখ টাকা দেন নগদ, বাকি টাকা চেকের মাধ্যমে। শেষ পর্যন্ত চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চান তিনি। আবদুল মালেক টাকা ফেরত দেননি। উপরন্তু চেক ডিজঅনারের মামলা ঠুকে দিয়ে তাকে জেলে পাঠান। সেই মামলায় তার আরও ৩ লাখ টাকা খরচ হয়। তিনি বলেন, ধারদেনা করে এত টাকা দেওয়ার পর আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। মনোবল হারিয়ে আর চাকরির পরীক্ষাই দেওয়া হয়নি। আমি চাই, আমার জীবন নষ্ট করে দেওয়া এ প্রতারকের শাস্তি হোক যেন আর কেউ এভাবে প্রতারিত না হন।
প্রতারণার শিকার ময়মনসিংহ জেলার এক যুবক আমাদের সময়কে জানান, তিনি ভিটেমাটিসহ জমিজমা বিক্রি উপরন্তু ধারদেনা করে আবদুল মালেকের হাতে একবারে ১৫ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি হয়নি। ভিটেমাটিহারা হয়ে এখন তিনি যাযাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের পরিবার সেই যে ভেঙে পড়েছে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
এ দুজন ছাড়াও আবদুল মালেকের প্রতারণার শিকার, এমন ২৫ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। তারা মালেকের ফাঁদে পড়ে কৃষি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি পদে চাকরির জন্য তাকে ও তার ভাই আবদুর রাজ্জাককে নগদ ও চেকের মাধ্যমে ২ কোটি ১৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু চাকরি পাননি, ফেরত পাননি টাকাও। অ্যাম্বিশন কোচিং, জাহান গ্রুপ ও এসএম ট্রেডার্সের নামে এসব টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা। এ ছাড়া নামে-বেনামে আরও বিপুল সংখ্যক টাকা তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। মালেক ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ১৯টি ব্যাংকে ১২৫ অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যাতে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা টাকা রয়েছে। এর মধ্যে বেশি লেনদেন হয়েছে ঢাকার সোনালী ব্যাংক আওলাদ হোসেন মার্কেট শাখা, মোহাম্মদপুরের ডিবিবিএল রিং রোড শাখা ও কুষ্টিয়া সোনালী ব্যাংকের আরএন শাখায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতারণা ও জালিয়াতির উদ্দেশ্যে মালেকের বড় ভাই আবদুর রাজ্জাকসহ ৪-৫ জন ঢাকার ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে একটি নামসর্বস্ব কোচিং সেন্টার চালু করেন। এই কোচিং সেন্টারের দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষি ডিপ্লোমা পাস করা বেকার যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে ভর্তি করা হতো। কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে টাকার বিনিময়ে চাকরির প্রলোভন দেখানো হতো। আবদুল মালেক নিজে কোচিং সেন্টারটির চেয়ারম্যান ও প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। ভর্তির পর মালেক ক্লাস নেওয়ার নাম করে ছাত্রছাত্রীদের প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন কথা বলতেন। কীভাবে পরীক্ষা না দিয়েও টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়া যায়, এমন সব প্রতারণামূলক গল্প বলে চাকরিপ্রার্থীদের প্রলুব্ধ করতেন। তার প্রলোভনে পড়ে অনেকেই চাকরির জন্য টাকা দিতেন। এভাবে মালেক বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন।
পুলিশ বলছে, কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করাসহ বিভিন্ন অজুহাতে মূল সনদপত্র জমা নিয়ে তাদের জিম্মি করতেন আবদুল মালেক। মূলত অ্যাম্বিশন কোচিং সেন্টার নামের এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল প্রতারণার উদ্দেশ্যে গড়া নামসর্বস্ব একটি সাইনবোর্ড। এ সাইনবোর্ড ব্যবহার করে তিনি তার আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাকরিপ্রত্যাশী ও তাদের অভিভাবকদের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করতেন।
জানা গেছে, রাজধানীর মনিপুরী এলাকা এবং ৬০ ফিট এলাকায় আবদুল মালেকের তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ঢাকা জেলার ধামরাই থানার ফোর্ডনগর এলাকায় ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ জমি রয়েছে। কুষ্টিয়ায় সদর থানাধীন বড়িয়া এলাকায় জাহান সুপার মার্কেট ছাড়াও নিজ গ্রামে ২৫ বিঘা জমি এবং একটি পাকা বাড়ি রয়েছে। কুষ্টিয়ায় তার জাহান গ্রুপ নামে একটি কনজ্যুমার প্রোডাক্ট কারখানা রয়েছে। কুষ্টিয়া এক্সপ্রেস নামে একটি বাস ও ৪টি ট্রাক রয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা।
মালেকের প্রতারণার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। সিআইডির অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক আমাদের সময়কে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের টাকায় আবদুল মালেক বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। ঢাকা শহরে তার নিজ নামেই তিনটি ফ্ল্যাট, কুষ্টিয়া শহরে জাহান মার্কেট এবং বিপুল জমি ও খামারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, প্রথমে আবদুল মালেক নিজ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এজেন্ট নিয়োগ করে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। ২০১৬ সালে তিনি অ্যাম্বিশন কোচিং সেন্টার চালু করেন। এখানে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কোটা (জেলা কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, এতিম কোটা, আনসার কোটা) শ্রেণিকরণ করতেন। সেই তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যাচাই-বাছাই করতেন। চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার সময় তিনি স্ট্যাম্প-চুক্তি করতেন কিংবা জমির দলিল জমা রাখার শর্তে চুক্তিবদ্ধ হতেন। এরপর প্রার্থীর ছবি পরিবর্তন/প্রশ্ন ফাঁস/প্রার্থীকে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাস করানো হতো। এ ছাড়া নাগরিক সনদপত্র পরিবর্তন, জন্মসনদ পরিবর্তন, চারিত্রিক সনদপত্র, এতিমখানার সনদপত্র, প্রতিবন্ধী সনদপত্র, চেয়ারম্যান প্রত্যয়নপত্র পরিবর্তনসহ যেসব জেলায় অধিক সংখ্যক জনবল নিয়োগের উল্লেখ থাকে জাতীয় পরিচয়পত্রে সেসব জেলার প্রার্থীর ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করা হতো। কোনো চাকরিপ্রার্থী চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে না পারলে তাদের জমাকৃত জমির দলিলের মাধ্যমে প্রার্থীর জমি দখল করে নিতেন।
কুষ্টিয়ার এক ভুক্তভোগী আমাদের সময়কে বলেন, আবদুল মালেকের প্ররোচনায় তার অ্যাম্বিশন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। ভর্তির পর আবদুল মালেকের প্রলোভনে পড়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে চাকরির জন্য কয়েকজন সাক্ষীর সামনে ১৩ লাখ টাকা দেন। পরবর্তীকালে চাকরি না পেয়ে মালেকের কাছে টাকা ফেরত চাইলে মালেক তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ঠুকে দিয়ে হয়রানি করতে শুরু করেন। এ ভুক্তভোগী বলেন, যেহেতু আবদুল মালেকের অনেক সম্পদ রয়েছে, সেই সম্পদ বিক্রি করে আমাদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।