সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রপতি হিসেবে আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হবে আবদুল হামিদের মেয়াদ। সংবিধান অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। নতুন রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিতে গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত এসেছে বা কাকে মনোনয়ন দেওয়া হলো জানা যায়নি। তবে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে গতকালও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের নাম আলোচনার শীর্ষেই ছিল। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নামও আলোচনায় আছে।
আগামী ২৩ এপ্রিল মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবনকে বিদায় জানাবেন। ওইদিনই তার ঢাকার অন্য কোনো বাসায় ওঠার কথা রয়েছে। বঙ্গভবন ছেড়ে যাওয়ার আগে আবদুল হামিদ এখানে রেখে যাবেন নানা সুখস্মৃতি। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার রেকর্ডও বঙ্গভবনের রেকর্ডবুকে রেখে যাবেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক। বিচক্ষণ, বিনয়ী, সদালাপি, পরোপকারী এবং বিতর্কমুক্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবেও নিজের নামটি রেখে যাবেন লাখো-কোটি মানুষের হৃদয়ে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। এর পর থেকে গত ৩৩ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কারও কারও বঙ্গভবন ছাড়তে হয় বিতর্ক সঙ্গে নিয়ে; কিন্তু সজ্জন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত আবদুল হামিদকে কোনো বিতর্ক স্পর্শ করতে পারেনি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ মো. আবদুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরের ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে আবদুল হামিদ সেদিন থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এর এক মাস পর ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। একই বছরের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের
৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সব মিলিয়ে টানা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন আবদুল হামিদ। এর আগে আর কোনো রাষ্ট্রপতি এত দীর্ঘ সময় বঙ্গভবনের বাসিন্দা ছিলেন না।
বঙ্গভবনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে, ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে এবং ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত স্পিকার মুহম্মদুল্লাহ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন খুনি মোশতাক আহমদ। ওইদিনই তিনি রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন খুনি মোশতাক। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১৯৭৮ সালের ১২ জুন পর্যন্ত মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৭৮ সালের ১২ জুন থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত, ১৯৮১ সালের ৩০ মে থেকে ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তিনি ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি, ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন, ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৬ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ১৯৮৬ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত আবদুর রহমান বিশ^াস, ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ, ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ২০০২ সালের ২১ জুন পর্যন্ত একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ২০০২ সালের ২১ জুন থেকে ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্পিকার ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকার (রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত), ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত মো. জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আবদুল হামিদের পূর্বসূরিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হিসেবে নাম আসে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের। তিনি ২০০৬ সালের শেষে এসে বেশ কিছু বিতর্কিত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সংবিধানের তোয়াক্কা না করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। ফলে দেশে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এ সময় তার কিছু একক ও পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। এই অবস্থা দেশে দুই বছর বলবৎ ছিল।
আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করে গভীর রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেন। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কারণে সে যাত্রায় দেশ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পায়।
একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হওয়ার মাত্র সাত মাস পরই বঙ্গভবন ছাড়তে বাধ্য হন। এর ফলেই কপাল খুলে যায় ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের। তিনি নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার দুবছর পরও স্বপদে বহাল ছিলেন। এই দুই বছর দেশে জরুরি অবস্থা বলবৎ ছিল। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়াজউদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মো. জিল্লুর রহমান।