রাজধানীর অনেক এলাকার জমির মূল্য বাড়ছে হু হু করে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজধানীতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভূমি জবরদখলের একাধিক প্রতারকচক্র। চক্রের সদস্যরা কখনো মৃত মানুষকে জীবিত করে; কখনো অস্তিত্বহীন ব্যক্তিকে মালিক সাজিয়ে সাধারণ মানুষের জমি লিখে নিচ্ছে। লিখে নিচ্ছে সরকারের অর্পিত (‘ক’ তালিকাভুক্ত) ও অধিগ্রহণকৃত জমিও।
অভিযোগ আছে, ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা ও দালালের সহযোগিতায় মালিকের ছবি পাল্টে গায়েব করে দিচ্ছে বালাম বইয়ের মূল পাতা। মূল নথিপত্র গায়েব করার অভিযোগও আছে। সন্দেহের বাইরে থাকতে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ভুয়া নম্বর সংযুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে মূল সার্ভারেও। আদালতের আদেশ ও ডিক্রিও পাল্টে ফেলছে চক্রটি। এ ছাড়া শুধু জমি দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের জাল দলিল ধরিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, এ চক্রকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছেন কিছু জনপ্রতিনিধি। ভূমি ও জাতীয় পরিচয়পত্র বিভাগের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত। ফলে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও দুদকের জালে ধরা পড়লেও দমানো যাচ্ছে না চক্রের দৌরাত্ম্য। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশ ও আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে একাধিক প্রতারকচক্রের আদ্যোপান্ত।
অর্পিত সম্পত্তির গেজেট ও পুলিশ সূত্র জানায়, এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পুরান ঢাকার নবাবপুরের ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৬৬৪ অযুতাংশ সম্পত্তির মালিক গোপীনাথ বসাক। স্বাধীনতার অনেক আগেই সপরিবারে ভারত চলে যান গোপীনাথ। তিনি কিংবা তার পরিবার আর ফেরেননি। এর পর ওই সম্পত্তি অর্পিত ‘ক’ তালিকাভুক্ত করে সরকার। সর্বশেষ
এই জমি লিজ হিসেবে বরাদ্দ পান আজহারুল হক খান নামে এক ব্যক্তি। এর পর লিজ নবায়নে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। আবেদনটি বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় জমিটি জবরদখল করেন স্থানীয় প্রভাবশালী জাবেদ উদ্দিন শেখ, মো. জাকির উদ্দিন ও তাদের সহযোগীরা।
এ ঘটনা তদন্ত করে আদালতে দুদক যে চার্জশিট দিয়েছে, তাতে উঠে এসেছে জালিয়াতির নানা নমুনা। তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।
দুদকের চার্জশিটে বলা হয়েছে, গোপীনাথ বসাক ও তার পরিবারের কোনো সদস্য আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের জমি ফেরত চাননি। এই তথ্য জানতে পেরে জাবেদ উদ্দিন ওই সম্পত্তি আত্মসাতে ‘অদৃশ্য’ গোপীনাথ বসাককে দাতা দেখিয়ে শ্রী ননী গোপাল বসাকের নামে তৎকালীন জয়দেবপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল (নং-৪০৩২) তৈরি করেন। পরে আরেকটি জাল কাগজ বানিয়ে ননী গোপাল বসাককে মৃত দেখানো হয়। এরপর ননী গোপালের ছেলে দাবি করে তপন কুমার বসাককে সামনে আনা হয় জমির ওয়ারিশ হিসেবে।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আসামিরা আদালতে তপন কুমার বসাকের একটি মৃত্যু সনদপত্র এবং তার ওয়ারিশান সনদপত্র দাখিল করেন। এতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর (সাবেক-৭০) ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্বাক্ষর রয়েছে। সনদপত্রের তারিখ দেওয়া আছে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর।
মৃত্যুসনদে উল্লেখ করা হয়- তপন কুমার বসাক নবাবপুরের সাং-হালে ২২১ ও ২২২ নম্বরের স্থায়ী বাসিন্দা। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর- ২৬৯৬৮২৭৮২৪৮৪৪। তিনি ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট বার্ধ্যক্যজনিত কারণে নবাবপুরের নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নথি ঘেঁটে জানান, তপন কুমার বসাকের এনআইডি নম্বর (২৬৯৬৮২৭৮২৪৮৪৪) নির্বাচন কমিশন অফিসের মূল সার্ভারে আছে। কিন্তু ঠিকানা দেওয়া আছে- উত্তরার বাসাবো। হিন্দু হলেও তার এনআইডির ধর্মের অংশে লেখা মুসলিম। আর বাধ্যতামূলক হলেও বসাকের কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি সার্ভারে। অর্থাৎ চক্রটি জাল করে ওই এনআইডি নম্বর সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মামুন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি কিংবা আমার দপ্তর থেকে কেউ তপন কুমার বসাকের নামে মৃত্যুসনদ বা তার ওয়ারিশানদের সনদ দেইনি। আদালতকে অন্ধকারে রাখতে কোনো চক্র জাল-জালিয়াতি করে হয়তো সনদগুলো বানিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কথিত তপন কুমার বসাক বাদী হয়ে আদালতে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ মোকদ্দমা দায়ের করেন। কিন্তু রাজধানীর সুবজবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার ও বংশাল থানাপুলিশ জানায়, তপন কুমার বসাক নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাবেদ ও জাকির একটি প্রতারকচক্রের হোতা। চক্রটি জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নবাবপুর রোডস্থ ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৩ তলা ভবনটি অবৈধভাবে দখল করেছে।
জাবেদ আদালতে ওই সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ে যে দলিল দাখিল করেন, তা সম্পূর্ণ জাল। এ ছাড়া জাবেদ তার অনুকূলে একটি মামলার ডিক্রি রয়েছে বলে আদালতকে জানান। ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত থেকে সেই মামলার নথি তুলে তাতেও গরমিল পাওয়া গেছে বলেও চার্জশিটে উল্লেখ করেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে গতকাল অভিযুক্ত জাবেদ উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, আমি কোনো জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত নই।
এদিকে রাজধানীর ডেমরার ডগাইর মৌজা সিএস ১৬৬১ ও ১৬৬৩ নম্বর দাগে অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক বিভাগের অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি জাল দলিলের মাধ্যমে দখলের অভিযোগ উঠেছে আল জয়নাল নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে। দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের সহযোগিতায় কোটি কোটি টাকার ওই সম্পত্তি তিনি দখল করেছেন বলে দুদক ও নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই অভিযোগ দাখিল করেন ভুক্তভোগী মো. রফিকুল ইসলাম।
গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর জানান, রেকর্ড অনুযায়ী ওই সম্পত্তি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণভুক্ত এবং সবার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সরকারি এই জমি কেউ দলিল করলে তা জাল বলেই গণ্য হবে।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে আল জয়নাল বলেন, আমি কোনো জালিয়াতি করিনি। কেউ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে।
ডেমরা অফিসের তৎকালীন ভূমি সাব-রেজিস্ট্রার মিশন চাকমা জানান, জমির যাবতীয় কাগজ সঠিক পেলে তবেই রেজিস্ট্রি করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটেনি। তথ্য লুকিয়ে কেউ যদি জমি রেজিস্ট্রি করে নেন, তার দায় দলিলদাতা ও গ্রহীতার ওপর বর্তায়।
মুন্সীগঞ্জের মনির হোসেন প্রায় ৩০ বছর ধরে সৌদি আরবে ব্যবসা করেন। দেশে ফিরে সিদ্ধান্ত নেন রাজধানীতে ফ্ল্যাট কিনবেন। এ জন্য তিনি যোগাযোগ করেন পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের ‘বি’ ব্লকে অবস্থিত ‘ফ্লাস পয়েন্ট রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) তাকে মিরপুর হাউজিং এস্টেটের ১১ নম্বর সেকশনের ‘বি’ ব্লকের ১২ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর ভবনের (ছয় তলাবিশিষ্ট) ৪টি ফ্ল্যাট ও একটি কার পার্কিং দেখান। ৪ হাজার ৫৩০ বর্গফুট আয়তনের ওই সম্পত্তির দাম চাওয়া হয় ১ কোটি ৫ত লাখ টাকা। নগদ ও ধার-দেনা করে ধাপে ধাপে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দেন মনির ও তার স্ত্রী। এরপর গত ১৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির অফিসেই বসে জমি রেজিস্ট্রির কমিশন। ওয়ারিশসহ ৬ দাতা এবং গ্রহীতাসহ ১৫ সাক্ষীর উপস্থিতিতে ৯৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্য দেখিয়ে সেখানেই পুরো সম্পত্তির সাফ-কবলা দলিল সম্পাদিত হয়। কিন্তু সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের এই আনুষ্ঠানিকতার পুরোটাই ছিল সাজানো। প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি মনির হোসেন ও তার স্ত্রী ফাতেমা হোসেন জানতে পারেন আমাদের সময়ের অনুসন্ধানের মাধ্যমে।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এ ঘটনায় ঢাকা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কয়েকজন ওমেদার (সাব-রেজিস্ট্রারদের মনোনীত কর্মচারী) জড়িত। কিছু দালালও আছে।
জাল দলিলে যে দলিল লেখকের নাম ছিল, তার নিবন্ধিত লাইসেন্স নম্বর-৮৯। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই লাইসেন্সের মালিক কাজ ছেড়েছেন ৮ বছর আগে।
ফ্লাস পয়েন্ট রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম জানান, ফ্ল্যাটগুলো আসলেই রেজিস্ট্রি হয়নি। আরও অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভূমি অফিসের লোকজনই এ কাজ করেছেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।