প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মোট ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এ সব চুক্তি বা সম্মতিপত্রের অধিকাংশই বিশেষ করে কানেক্টিভিটি বা ট্রানজিট এবং ঋণের বিষয়ে করা চুক্তির বিস্তারিত বিষয়বস্তু দুই দেশের কেউই প্রকাশ করেনি। ভারতকে ট্রানজিট, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জায়গা দেওয়া— এ সব সুবিধা বাংলাদেশ দিয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ কী সুবিধা পেল তা পরিষ্কার নয়। সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করে বোদ্ধারা বলছেন, মোদির সফরে ভারত বাংলাদেশকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে সম্পাদিত ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি বাংলাদেশের আরও ৪১ বছর আগে পাওয়ার কথা ছিল, যা মোদির সফরে মিলেছে। বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা বিষয়ে মুখের বুলি পাওয়া গেছে, কোনো চুক্তি হয়নি। বাণিজ্য চুক্তির নবায়ন করা হয়েছে, নৌপথে ট্রানজিট ও বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
ভারতের ঋণের বিষয়ে সমঝোতা, বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ভারত ব্যবহারে সমঝোতা, ভেড়ামারায় ভারতকে অর্থনৈতিক অঞ্চল দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। কিন্তু এই সমঝোতা স্মারকের বিস্তারিত এখনো দুই দেশের কেউই প্রকাশ করেনি।
নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশ থেকে ভারতের পাওয়া অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো পরিষ্কার হলেও বাংলাদেশ ভারতে কাছ থেকে কী অর্থনৈতিক সুবিধা পেল তা পরিষ্কার নয়। ভারত বাংলাদেশকে যে ঋণ দিবে তা ভারতের ব্যবহারের জন্য ট্রানজিট বিষয়ক অবকাঠামো খাতের উন্নয়নেই ব্যয় হবে।
মোদির সফরের আগে ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট এবং মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মোদির সফরে ট্রানজিট বিষয়ে একটি শব্দও নেই। আর মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে কিছুই আমার চোখে পড়েনি।’
মোদির ঢাকা সফরের আগের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘ট্রানজিট এবং মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু মাশুল ঠিক হয়নি। এটা পরে ঠিক করা হবে।’
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মোদির সফরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য করতে পারবে। বিষয়টি পরিষ্কার নয়। বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে হলে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার দূর করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো আলোচনা শুনিনি। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে দুই দেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, এই বিষয়েও অপূর্ণতা রয়ে গেছে। ঋণের বিষয়টি যদি আবারও আগের মতো হয় যে ভারতই মূল্য ঠিক করে দিবে এবং তাদের থেকেই উপাদান কিনতে হবে, তাহলে এই ঋণ আমাদের কোনো কাজে আসবে না। মোদি তার ভাষণে বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে বিনা শুল্ক ও কোটায় প্রবেশের কথা বলেছেন। এটা আগেও ছিল, নতুন করে বলার কিছু নেই। সার্বিকভাবে আমরা কতখানি সুবিধা পাব তা ভবিষ্যতে ফলোআপ করলে বোঝা যাবে।’
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মোদির সফরকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এই সফরে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কী পেল। রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে অনেক অগ্রগতি এবং সুসম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলে এই সফরে ভারত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে এটা পরিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে তা পরিষ্কার নয়।’
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতে মূলত কানেক্টিভিটি প্রয়োজন। এই প্রয়োজন এই জন্য যে বাংলাদেশের বিশাল বাজার এ ভারতের নিয়ন্ত্রণ বা শেয়ার করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টা পরিষ্কার নয়। মোদির সফরে ভারতের বিনিয়োগকারীরা সুবিধা পেয়েছে, বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা নয়। কেননা, ভারতের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যে ভারতে জায়গা চায় সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নৌ প্রটোকল ভারতের স্বার্থেই দেওয়া হয়েছে। আবার ভারতের আদানি ও রিলায়েন্স প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যা কুইক রেন্টালের আদলে, এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। পরিবেশবাদীরা অনেক সোচ্চার হওয়ার পরও সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে চুক্তি হল। মোদির উচিত ছিল এই বিষয়ে আরও খোঁজ-খবর নিয়ে চুক্তি করা। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ওই জায়গাতেই কেন করতে হবে তা বোধগম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মংলা ও চট্টগ্রাম ভারতকে ব্যবহার করতে দিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ হবে তা পরিষ্কার না। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে এবারও আশ্বাস পেলাম, কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হল না। ভারতের ঋণ এটা একটা রাজনৈতিক চালাকি। কেননা, ওই ঋণের অর্থ তাদের (ভারত) প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ সব বিষয়ে স্বচ্ছতা নেই বলেই চুক্তিগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না।
অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমি এখনো কোনো চুক্তির বিস্তারিত হাতে পাতে পাইনি, দেখিনি। তাই বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে সাবধানে এবং দেখেশুনে চলতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে, শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিবেশী কম শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতি ছোটভাই সুলভ আচরণ করে। শক্তিশালী রাষ্ট্র সব সময়েই প্রতিবেশীর প্রতি ‘বিগ ব্রাদার’ বা ‘এল্ডার ব্রাদার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যাকে বাংলায় বলে ‘দাদাগিরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু ওইটা ছিল সাপ্লাইয়ারর্স ক্রেডিট। যার মানে হচ্ছে, ঋণের অর্থ ভারতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। ঋণের অর্থে যে উন্নয়ন হবে, ওই উন্নয়নের জন্য যে কাঁচামাল লাগবে তার মূল্য ঠিক করে দিবে ভারত, আবার সেই কাঁচামালের মূল অংশ ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে।’
ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘যারা এগুলো নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তারা এই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক বা প্রটোকলের কতখানি জানেন বা দেখেছেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এর আগে ৮০-এর দশকে ভারতের ঋণের অর্থে বাংলাদেশে কলম উৎপাদিত হল। পরে দেখা গেল, যে কলম আগে বাজারে এক টাকায় বিক্রি হতো। পরে তার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হল।’
এদিকে ঢাকা সফরে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘এই সফরকে বিশ্ব সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করবে, মাপকাঠি দিয়ে দেখবে, এই সফরে বাংলাদেশ কী হারাল আর কী পেল। আমি এই বিষয়ে একবাক্যে বলব, লোকেরা আগে মনে করত যে আমরা বাংলাদেশের খুব আশপাশে রয়েছি। কিন্তু বিশ্বকে আজ স্বীকার করতে হবে, আমরা বাংলাদেশের আশপাশেও আছি এবং সঙ্গেও আছি। আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলব। কেননা, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের শুধু রাজনৈতিক নয়, আবেগপূর্ণ যোগাযোগ রয়েছে।