ঢাকা: ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৪১ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হলো। উন্মোচিত হলো ছিলমহলবাসীর ভোটার হওয়ার দ্বার। এর আগে বারবার উদ্যোগ নিয়েও স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মতি না পাওয়ায় তাদের ভোটার করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সূত্র জানিয়েছে, ছিটমহলবাসীকে ছবিসহ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে কয়েক দফা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলো ইসি। কিন্তু স্থলসীমান্ত চুক্তির বিষয়টির মীমাংসা না হওয়ার সম্মতি দেয়নি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যে কারণে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির দলিলও দিতে পারেনি কমিশন।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, শনিবার (৬ জুন) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে দু’দেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হওয়ায় ছিটমহল বিনিময়ের দ্বার পাকাপোক্তভাবে উন্মোচিত হলো। ফলে ছিটমহল বিনিময় হয়ে গেলে আগামী হালনাগাদ কার্যক্রমেই ছিটমহলবাসীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
একইসঙ্গে ছিটমহলবাসীকে নাগরিকত্বের অন্যতম দলিল জাতীয় পরিচয়পত্রও সরবরাহ করবে নির্বাচন কমিশন।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ছিটমহলবাসীকে ভোটার করতে সে বছরের ৯ জুন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় নির্বাচন কমিশন। ইসির জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মাহফুজা আক্তার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছিলো- ‘গত ১৫ মে (২০১৪ সাল) সারাদেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জনবসতি আছে এমন বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোতে ভোটার তালিকা হালনাগাদের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে নির্বাচন কমিশন ছিটমহলগুলোতে তথ্য সংগ্রহ ও রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিটমহলসমূহের হস্তান্তরের বিষয়ে মতামত এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য নিদের্শক্রমে অনুরোধ করা হলো’।
এরপর মন্ত্রণালয় দু’টি জানায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত বিষয়টি বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত দ্বি-পাক্ষিক এবং চলমান বিষয়ের মধ্যে সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। বিরোধ নিষ্পত্তি হলে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় হবে।
তাই ছিটমহল নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালানাগাদ না করার জন্য বলে দুই মন্ত্রণালয়। এ মতামতের পর ইসি আর সে উদ্যোগ থমকে যায়।
ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ২০১২ সাল এবং ২০১৪ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় মন্ত্রণালয় দু’টির মতামত চাওয়া হয়েছিলো। তারা স্থলসীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ছিটমহলের ভোটার তালিকা কার্যক্রম গ্রহণ না করতে মতামত দেয়। ফলে ছিটমহলবাসীকে ভোটার করা হয়নি। তবে যতো দ্রুত ছিটমহল বিনিময় হবে, ততো দ্রুত আমার সেখানে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবো।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ঈদের পরে ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য সারাদেশে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করবে কমিশন। এ সময়ের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়ে গেলে সেখানেও তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৭ সালের যৌথ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিনিময়যোগ্য ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২টি। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি, যার মোট আয়তন সাত হাজার ১১০ একর। এসব ছিটমহলে ১৪ হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে। এসব ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কোচবিহার এবং চারটি জলপাইগুড়ি জেলায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহলের সংখ্যা ১১১টি। এর মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ এবং নীলফামারীতে চারটি ছিটমহল রয়েছে। যার মোট আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর। এসব ছিটমহলে ৩৭ হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে।
১৯৭৪ সালে স্থলসীমান্ত বিরোধ মীমাংসায় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে অনুযায়ী, একই বছরের ২৮ নভেম্বর সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশ। ভারত সংবিধান সংশোধন করে গত মে মাসে। সম্প্রতি তা ভারতের মন্ত্রিসভার অনুসমর্থনও পায়।
শনিবার দু’দেশই অনুসমর্থের দলিল হস্তান্তর করলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা কক্ষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর নিজ নিজ দেশের পক্ষে অনুসমর্থনের দলিল হন্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সফরররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে এ দলিল বিনিময় হয়।