তড়িঘড়ি করে ডাকা গত শুক্র ও শনিবারের বাস ও মিনিবাস ধর্মঘটে শুধু ফরিদপুরের মালিকদেরই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২২ লাখ টাকার বেশি। আর এই পরিবহনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা বঞ্চিত হয়েছে তাদের দুদিনের আয় থেকে যা পরিমাণ ২৩ লাখ টাকা। ফরিরপুরের বড়বাস ও মিনিবাসের মালিক ও শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যের নিরিখে পাওয়া গেছে এ পরিসংখ্যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদপুরে পরিবহন, লোকাল ও মিনিবাস মোট ৫৭৬টি। এর মধ্যে মিনিবাস ১৩১টি, লোকাল রুটে বড়বাস ১৯৫টি এবং পরিবহন বাস ২৫০টি। ফরিদপুর শহর থেকে টেকের হাট, সদরপুর, সালথা ও মুকসুদপুর এই চারটি রুটে চলে মিনিবাস। ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলা ও পাশের জেলাগুলোতে চলে বড় লোকাল বাস। রাজধানীসহ দূরপাল্লার জেলায় যায় পরিবহন বাস।
ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং জেলা মিনি বাস মালিক গ্রুপের সহ-সভাপতি মো. শাহীন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি মিনিবাসে প্রতিদিন কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ টাকা আয় মালিকের, সে হিসেবে দিনের মোট আয় হয় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে বড় লোকাল বসের দিনের মোট আয় ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। দূরপাল্লার পরিবহনে বাসপ্রতি আয় দিনে কম করে ২ হাজার ৫০০ ধরলেও প্রতি দিন মোট আয় সোয়া ৬ লাখ টাকা। দুদিনের হিসেবে মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
এদিকে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব বাসেই কমপক্ষে ড্রাইভার, সুপারভাইজার ও হেলপার এই তিনজন শ্রমিক থাকে। তাদের গড়ে কমপক্ষে মোট দুহাজার টাকা মজুরি। সে হিসেবে ৫৭৬টি বাসের শ্রমিকদের মোট আয় ২৩ লাখ ৪ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে আরও সত্যতা মেলে এই বিতর্কিত পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে বিএনপি নেতাদের করা অভিযোগের। শুধু ফরিদপুরের জেলার সব রুট এই ধর্মঘটের আওতায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় গনসমাবেশস্থল ফরিদপুর শহরতলীর কোমরপুরে যাবার জন্য যে মহাসড়ক ব্যাবহারের প্রয়োজন সেই রুটগুলোতেও আশপাশের জেলায় ওই দুই দিন চলেনি বাস, বাকি সড়ক রুটে বাস চলাচল করেছে। যেমন মাদারীপুরের সঙ্গে শুধু ফরিদপুরের পরিবহন বাস রুটটি বন্ধ রাখা হয়, একইভাবে গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। রাজবাড়ী জেলা থেকে ফরিদপুরগামী বাসগুলোও ছিল ধর্মঘটের আওতায়।
গত ৭ নভেম্বর ফরিদপুর জেলা পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্যপরিষদের প্যাডে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে এ সংগঠনের ফরিদপুরের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নাসির স্বাক্ষরিত একটি পত্রে কিছু দাবি-দাওয়ার বাস্তবায়ন চেয়ে আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে তার সমাধান চেয়েছে। তা না হলে ১১ নভেম্বর সকাল ছয়টা থেকে ১২ নভেম্বর রাত ৮টা পর্যন্ত এ ৩৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট করবে বলে জানানো হয়। ওই দিন বিকেলে এ চিঠি জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয়।
গত ৯ নভেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ফরিদপুর বিভাগীয় গণসমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, বিএনপির গণসমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করা, জনসমাগম সংকুচিত করা এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করার জন্য বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির নাম তারা ব্যবহার করেছে। আর বাস-মিনিবাস মালিক সমিতিও সরকারের ইশারায় পুতুল নাচের মতো নাচছে।
বিএনপির সমাবেশে বাসবন্ধ গোপালগঞ্জে ক্ষতি ১০ লাখ টাকা
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ফরিদপুরে বিএনপির মহাসমবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ থেকে ফরিদপুর হয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ঢাকার পরিবহন ২ দিন বন্ধ ছিল। এতে ১০ লাখ ১২ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ওই রুটে কমফোর্ট লাইন, দিগন্ত, গোল্ডেন লাইন, সেবা গীণলাইন, সুবর্ণ পরিবহন ঢাকা-গোপালগঞ্জ যাতায়াত করে। প্রতিদিন এসব গাড়ির ৪৪টি ট্রিপ যাতায়াত করে। পদ্মা সেতু চালুর পর ওই রুটে গাড়ি চলাচল কমে গেছে। এছাড়া ওই দিন গোপালগঞ্জের সবরুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
গোপালগঞ্জ মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ওই রুটে কমফোর্ট লাইনের ৩টি, গোল্ডেন লাইনের ৪টি সেবাগ্রীণ লাইনের ৩টি, সুবর্ণ পরিবহনের ২টি ও দিগন্ত পরিবহনের ১০টি ট্রিপ যাতায়াত করে। এতে প্রতিদিন আপ-ডাউনে ৪৪টি গাড়ি চলাচল করে। ফরিদপুর বাস মালিক সমিতি ধর্মঘট ডাকায় দুইদিন ওসব গাড়ির ৮৮ট্রিপ চলাচল করেনি। এতে মালিক ও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দিগন্ত পরিবহনের চেকার মিলন শেখ বলেন, গাড়িপ্রতি ট্রিপ নিয়ে গেলে মালিক ১০ হাজার টাকা পান। আর ড্রাইভার, হেলপার ও সুপারভাইজার পান ১ হাজার ৫০০ টাকা। সেই হিসেবে বাস মালিকরা ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে। আর ওইসব পরিবহনের ২৬৪ জন শ্রমিক ১ লাখ ৩২ হাজার টাকার পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কমফোর্ট লাইন পরিবহনের শ্রমিক মিজান মোল্লা বলেন, দুইদিন কাজে যেতে পারিনি। তাই দুইদিনের পারিশ্রমিকও পাইনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে দু’দিনের পারিশ্রমিক ১ হাজার টাকা না পেয়ে চলতে খুব কষ্ট হয়েছে। স্ত্রী সন্তানদের মুখে ধার দেনা করে খাবার তুলে দিয়েছি।
পরিবহন মালিক হাসেম আলী বলেন, প্রতিদিন গাড়ি পাঠালে অন্তত ১০ হাজার টাকা ঘরে আসে। দু’দিন গাড়ি চলেনি এতে গাড়ি প্রতি ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
কমফোর্ট লাইন কাউন্টারের কর্মী ইলিয়াস শেখ বলেন, দুইদিন গাড়ি চলাচল করে নি। তাই বেতনও পাইনি। বেতন না পেয়ে স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে চলতে দুই দিন খুব কষ্ট হয়েছে। আমরা দিন মজুর শ্রেণির মানুষ। তাই এই ধরণের ধর্মঘট আমরা চাই না।
দিগন্ত পরিবহনের চালক সোহেল মিয়া বলেন, গাড়ি বন্ধ থাকলে পেটে ভাত যায় না। পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়। এই ধরণের ধর্মঘট না করলেই ভালো হয়।
বাস ধর্মঘটের বিষয়ে অধিকাংশ মালিক-শ্রমিকই একমত ছিলেন না
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান,সড়ক মহাসড়কে মাহেন্দ্রসহ ত্রিচক্রযান চলাচল বন্ধের দাবিতে দুদিনের বাস ধর্মঘটের বিষয়ে অধিকাংশ মালিক শ্রমিকই একমত ছিলেন না। কোনো কোনো শ্রমিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই ধর্মঘটের বিষয়ে। তারা বলছেন, বর্তমান বাজারে যেখানে মানুষের টিকে থাকাই কষ্টের সেখানে এ ধর্মঘট তাদের জীবনধারা অনেক কঠিন করে দিলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাস মালিক বলেন, এই ধর্মঘটের বিষয়ে তারা একমত নন। সমিতি থেকে তাদের বাস বন্ধ রাখতে বলায় তারা বাধ্য হয়েছেন বন্ধ রাখতে।
রাজবাড়ী-ফরিদপুর রুটে চলাচলকারী লোকাল বাসের চালক রইস উদ্দিন জানান, ধর্মঘটের লাভ-ক্ষতি বোঝেন না। পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষ তাদের বন্ধ রাখতে বলেছে তারা বন্ধ রেখেছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু তার বলার নেই।
দৌলতদিয়া-কুষ্টিয়া রুটে চলাচলকারী বাসের চালক ফজলুর রহমান বলেন, আমরা তো হুকুমের গোলাম। যা বলবে তাই শুনতে হবে। একটা দিন বাস না চললে অনেকের সংসার চালানো কষ্ট এ কথা কেউ বোঝে না। মানুষকে মন্তব্য করতে শুনি, বিরোধীদলের সমাবেশের কারণে এই ধর্মঘট।
রাজবাড়ী পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রকিবুল ইসলাম পিন্টু বলেন, এই ধর্মঘটে আমাদের ক্ষতিই হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় যেখানে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে সেখানে দুইদিন কর্ম থেকে বিরত রেখে জীবন আরও কঠিন হয়ে গেছে। বাস বন্ধ থাকলেও শ্রমিকরা কোনো প্রণোদনা বা ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে জানান তিনি।
বাস মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, এই ধর্মঘটের বিষয়ে নেতাদের জিজ্ঞেস করেন লোকজন জিম্মি করে সাধারণ মালিকদের ক্ষতি করে কি লাভ হলো।
বাস মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, গাড়ি না চললে মালিক-শ্রমিক সবারই সমস্যা। তাদের বন্ধ রাখতে বলেছেন তাই বন্ধ রেখেছেন।