বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের ছেলে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। জেলহত্যা দিবস নিয়ে তিন দাবি, জাতীয় চার নেতার মূল্যায়ন প্রসঙ্গ, বর্তমান রাজনীতি, রাজনীতি বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, দুর্নীতি, সুশাসন, সামনে জাতীয় নির্বাচন, আওয়ামী লীগের আগামী নেতৃত্বসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। নিয়েছেন সাক্ষাৎকার।
প্রশ্ন: তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধে পিচ্ছিল পথটির পথপ্রদর্শক হয়ে প্রজ্ঞা, সাহস, সততা ও দক্ষতার আলো ছড়িয়ে দেশ স্বাধীন করতে ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার যে মূল্যায়ন পাওয়ার কথা তা কি তিনি পেয়েছিলেন?
সোহেল তাজ : এই প্রশ্নের উত্তর কি আমি তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে হিসেবে দেব নাকি নাগরিক হিসেবে দেব?
প্রশ্ন : দুই দিক থেকে উত্তর আশা করছি।
সোহেল তাজ : একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিশ্বাস করি একটি দেশ একটি জাতির গুণগত ও মানগত উন্নতি চাই এবং সার্বিকভাবে উন্নতি অগ্রযাত্রা চাই ভবিষ্যতের পথে, তা হলে মানবসম্পদ গঠন করা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মানবসম্পদ গঠন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্মকে ধাবিত করতে হবে। ভবিষ্যতের পথে যাতে তারা ন্যায়, নিষ্ঠাবান, নীতিবান এবং সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের চালিত করতে পারে। তা হলেই কিন্তু আমরা সেই গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। সেটা কীভাবে করা সম্ভব! যদি সেই ব্যক্তি নতুন প্রজন্ম উজ্জীবিত হয়। এবং তাদের উজ্জীবিত করতে পারি তাদের দেশপ্রেমের উৎসাহী হলে তার ইতিহাস জানা! আমাদের ইতিহাস হচ্ছে- গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, আমাদের ইতিহাস হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- আমাদের ইতিহাস হচ্ছে বীরের ইতিহাস। আমাদের হচ্ছে যুদ্ধ করে, লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনে স্বাধীনতা এবং একটি বিজয়ের ইতিহাস। এর চেয়ে বড় প্রাণশক্তি কী হতে পারে নতুন প্রজন্মের জন্য। একটি নতুন প্রজন্মকে আমরা যদি সঠিক পথে ধাবিত করতে চাই এবং দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে চাই তা হলে নতুন প্রজন্মের দেশকে নিয়ে, জাতিকে তার সত্তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতে হবে। আমাদের গর্বের ক্ষেত্রটাই হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা আবশ্যক। এবং তাজউদ্দীন আহমদ সেহেতু সেই ইতিহাসের বড় একটা অংশ রাষ্ট্রের স্বার্থে, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে মনে করি তাজউদ্দীন আহমদকে এবং তার যে তিন সঙ্গী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের পৃথক পৃথক কর্মকাণ্ডের জন্য। তাদের অবদানের জন্য। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমরা জানি এই জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে যখন পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। তখন এই চার নেতাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোন সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্নায়ুযুদ্ধ চলে জটিল ভূরাজনীতি-সোভিয়েত রাশিয়া বনাম পশ্চিমা বিশ্ব, এই জটিল ভূরাজনীতি থাকা অবস্থায় মোকাবিলা করে কূটনৈতিকভাবে আমাদের জন্য সমর্থন আদায় করতে এক কোটি শরণার্থীকে দেখভাল করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র সজ্জিত করে প্রশাসনকে সামাল দিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে আমাদের দেশকে স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এই চার নেতা। এই চার নেতার মধ্যে একজন উল্লেখযোগ্য হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। যিনি আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং মূল্যায়ন করতে হবে। তা করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। সন্তান হিসেবে আমি মনে করি আরও এক হাজার গুণ বেশি।
প্রশ্ন : আপনি তরুণ প্রজন্মের কথা বলেন, এই তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার জন্য রাজনীতিবিদরা কতটুকু ভূমিকা পালন করছেন বলে আপনি মনে করেন?
সোহেল তাজ : তরুণ প্রজন্ম ও নতুন প্রজন্ম আসলে আমরা যদি একটা সার্ভে নেই তা হলে দেখি বেশিরভাগই হতাশ। এই তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ। এই সত্যটা যদি অস্বীকার করি তা হলে মিথ্যা কথা বলা হবে। এই হতাশার কথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : কেন বিমুখ?
সোহেল তাজ : আমাদের যে সমস্যা। আজকে আমাদের বর্তমান সরকারের কথাই বলছি। আমি বলছি, আমাদের রাজনীতির কালচারের কথা। এই রাজনীতির কালচার যুগ যুগ ধরে হয়ে এসেছে। আমি বলছি, রাজনীতির এই কালচারটা পরিবর্তন করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি কোন কালচারের কথা বলছেন?
সোহেল তাজ : দুর্নীতির কালচার। অনিয়মের কালচার। অব্যবস্থাপনার কালচার। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ভাবে ন্যায়বিচার নেই। অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এটা সমাজে ভীষণভাবে বিরাজ করছে। বর্তমানের সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমাদের ইতিহাস জানিয়ে উজ্জীবিত করা। আমি মনে করছি এখন পর্যন্ত আমরা সে কাজটি সঠিকভাবে করতে পারিনি। দুর্নীতি প্রতিরোধের কাজটি আওয়ামী লীগকেই করতে হবে।
প্রশ্ন: তিন নভেম্বর স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রদ্ধাভরে পালন করার কথা কিন্তু শোকাবহ জেলহত্যা দিবস সীমিত আকারে পালন করা হচ্ছে। এটা সীমিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন সীমিত আকারে পালন করা হচ্ছে, এর কারণ কী?
সোহেল তাজ : এই কারণ তো আমি বলতে পারব না। এই কারণ তো আমিও খুঁজছি। আসল কারণটা কী। কারণ, জেলহত্যা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা এবং স্বীকৃতি দেওয়া কার জন্য সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যা হওয়ার কথা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের। আমাদের বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হলে কার ক্ষতি হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের। এটা আমার তৃতীয় দাবি মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছেন অবদান রেখেছেন। তাদের স্বীকৃতি দিলে ক্ষতিটা কার হবে? আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী যারা করেছে। তাদের আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা হয়তো ব্যস্ত সেজন্য পর্যন্ত হয়নি। আমার যে উপলব্ধি গত ২১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে যেটা বলেছি, একজন মা তার শিশু সন্তানকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন এবং নিজের প্রাণ দেবে শিশুর জন্য কিন্তু সেই শিশুটির যদি খিদে লাগে বা অস্বস্তিবোধ করে, সে যদি কান্না না করে মা কিন্তু তাকে মনোযোগ নাও দিতে পারেন। আমি মনে করছি আমার এই তিন দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশ হচ্ছে সেই শিশু, সেই শিশু আজ কান্না করছে। আমি আশা রাখছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে, স্পিকারের কাছে আমি তিন দাবি দিয়েছি। সংসদ সদস্যদের দিয়েছি এবং সংসদের নেতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই সেই মায়ের ভূমিকা পালন করবেন। শিশুর দিকে তাকাবেন এবং মনোযোগ দেবেন।
প্রশ্ন: আপনি যেখানে যেখানে দাবি পৌঁছে দিয়েছেন সেখান থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন কিনা?
সোহেল তাজ : সাড়া পেলে তো আর আপনাদের সঙ্গে এখানে কথা বলতাম না; মিষ্টি খাওয়াতাম।
প্রশ্ন : আপনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে জাতীয় চার নেতার জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ : আমি যখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলাম তখন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সে সময়টা জটিল সময় ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। আমি সে সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সহায়তা করেছিলাম। আমি কিন্তু বিহাইন্ড দ্য সিন হিসাবে কাজ করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু আগে জেলহত্যা প্রহসনের যে রায় হয়েছিল ২০০৪ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমান সাহেব সে সময় একটি ইনডেমনিটি আইন জারি করলেন। তখন এতে বলা হলো এসব বিচার করা যাবে না। পরবর্তী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা বিচারকার্য শুরু করলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারকার্য শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করলেন। ২০০১ সালে সেটা একপর্যায়ে ছিল। পরে আমরা যারা ভুক্তভোগী বিচার কার্যক্রম দেখার জন্য কোর্টে গিয়েছি। ২০০১ সালে যখন কোর্টে গিয়েছি তখন আমাদের মনে হয়েছে আমরা আসামি পক্ষ। যারা বিচারাধীন তাদের মনে হয়েছে। সম্পূর্ণ বিচার প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। বিভিন্ন সাক্ষীকে ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ গায়েব করে একটি প্রহসনের রায় দিল। প্রহসনের রায় কেন বলছি আমি। এ রকম একটা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর যারা ঘটিয়েছে। যারা প্রত্যক্ষভাবে গুলি চালিয়েছে। তাদের পেছনে তো মাস্টারমাইন লাগে। দেখা গেল এই রায় যখন এসেছে, ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে, এই রায়তে যারা গুলি চালিয়েছে রিসালদার মোসলহেউদ্দীন আরও একজন তাদের ফাঁসি দেওয়া হলো। আর যারা মাস্টারমাইন্ড সাবেক মন্ত্রী কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নূরুল ইসলাম মঞ্জু ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেওয়া হলো। এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলার ফাঁসির রায়প্রাপ্ত আসামিদের আবার দণ্ড দেওয়া হলো। আর বাকি যারা পলাতক তাদের যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। পরে আবার যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলো ২০০৮ সালে। তখন আমরা এটাকে আপিলে। এতকিছু জানি কারণ এগুলো করেছি। আমি চেষ্টা করেছিলাম। এটাকে আপিল স্টেজে নেওয়া যায় কিনা। এখন যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তার সঙ্গে আমি অনেক কথা বলেছি। জেলহত্যা নিয়ে তখন তিনি বলেছিলেন, নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে। এখন আপনারা আপিল করতে পারেন। কিন্তু আপিল করাটা সমস্যা হবে তাই দেখা গেল কারণ এভিডেন্সগুলো ডিসটয় করা হয়েছে। যার ফলে আপিলেও নিম্ন আদালতে রায় বহাল রাখা হয়। প্রকৃতপক্ষ আমরা এখন পর্যন্ত জেলহত্যার সঠিক বিচার পাইনি।
পাইনি বলে তো এখন কান্না করলে হবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে। এটাও একটা সমাধান আছে। আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এটাই আমরা সবাই চাই। আমরা তো চাই বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম ভালো একটা দেশে বসবাস করতে পারে। এটা ভালো দেশ পাক।
আমি মনে করি বাংলাদেশের নাগরিকদের সত্যটা জানতে হবে। তা হলে একটা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। জেলহত্যার পেছনে কারা জড়িত ছিল, কারা মাস্টারমাইন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পেছনে করা ছিল, কারা খুঁটি নেড়েছে। এগুলো জানার জন্য একটা কমিশন হতে পারে। যাতে করে আমরা জনগণের সামনে তুলে আনতে পারি। অনেক সময় বিচারের মাধ্যমে আইনের মধ্যে সত্য উদঘাটন হয় না।
প্রশ্ন: আপনার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ এবং মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। সে প্রেক্ষিতে আপনার অবস্থান জানতে চাই।
সোহেল তাজ : আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে সময় তাদের কিন্তু প্রাণ রক্ষার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেননি। তারা দেশ, জাতি ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তারা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন ঘাতকদের গুলি। সেই বাবার সন্তান কিন্তু আমি। আমার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ঠিক আমার বাবা একাত্তর সালে দুঃসময়ে হাল ধরেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী জিয়াউর রহমান রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে ঠিক সেই সময় আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করেছিলেন আমার মা। আমার মা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া গিয়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে আমিও গিয়েছি। আমি নিজেই সাক্ষী। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেলের পেছনে এবং কাটামাটির ভেতর দিয়ে গরুর গাড়িতে করে মিটিং করেছেন। সেই মায়ের সন্তান আমি। রক্তে আওয়ামী লীগ, আদর্শে আওয়ামী লীগ, এর বাইরে তো কোনো স্থান নেই। হতেই পারে না। একটা কথা আমি বারবার বলছি। আমার কথা স্পষ্ট, যদি আওয়ামী লীগের প্রয়োজন মনে হয় বা ডাক আসে আমি সাড়া দেব। তাই অ্যাকটিভ পলিটিক্সে না থাকলেও মনেপ্রাণে দলের সঙ্গে আছি। আমার প্রাণের দল আওয়ামী লীগ। আমি সব সময় থাকব।
প্রশ্ন: দলের কোন পদে থাকলে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন?
সোহেল তাজ : আমার সবচেয়ে বড় পদ হচ্ছে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সন্তান। এর থেকে আর কোনো বড় পদ আমার দরকার নেই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে। কখনো যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান তা হলে বাংলাদেশটাকে কীভাবে গড়তে চান।
সোহেল তাজ : এটা খুবই বড় একটা প্রশ্ন হয়ে গেল। আমি এই প্রশ্নের দিকে না যাই। আমরা যদি এখন থেকে সবাই চেষ্টা করি। আমাদের দেশের সঠিক ইতিহাসটা তুলে ধরতে পারি তা হলে নতুন প্রজন্মকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ করবে। সুশাসনের জন্য কাজ করবে। তা হলে আমরা একটা সুন্দর দেশ রেখে যেতে পারব।
প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন। থাকবেনও। এর পরও আপনার মধ্যে নিরপেক্ষ একটা ব্যাপার লক্ষ করছি। সে বিবেচনায় জানতে চাওয়া- নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে যেমন- নির্বাচন কমিশন। এসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের জন্য সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা?
সোহেল তাজ : আমি আশা করব যে, স্বাধীনভাবে কাজ করবে। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে কী হয়? জনগণ কিন্তু আস্থা হারায়। রাষ্ট্রের ওপর যদি আস্থা হারায় আমরা এই যে আলাপগুলো করলাম। ভবিষ্যতের বিনির্মাণের সে পথটা কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়। আমি আশা করব নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। নিরপেক্ষভাবে পালন করবে। আমি মনে করি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
প্রশ্ন: জাতীয় চার নেতার নীতি আদর্শ কীভাবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি?
সোহেল তাজ : এজন্যই তো আমার তিনটা দাবি। তিন নম্বর দাবিতে বলা আছে জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব বেসামরিক ও সামরিক সংগঠক, পরিচালক, অমর শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা যদি আমেরিকার দিকে তাকাই তাহলে সিভিকস স্টাডি নামে একটা বিষয় আছে সেটা না নিলে পড়তে পারবে না। সেখানে একটা বিষয় পড়ায় কীভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আমেরিকাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করেছে। জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে এবং তার পাশে ছিল অনেকেই। আমেরিকার ডলার ও বিলবোর্ডগুলোতে একেকজনের ছবি দেওয়া আছে। তা কেন করেছে? জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য। জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে আরও যোগ্য ব্যক্তিরা ছিলেন। বই পড়লে দেখা যাবে আমেরিকার সবার জীবনী দেওয়া আছে। শুধু বইপুস্তকে না, সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতকে দেখতে বোঝাবে আমাদের মহাত্মা গান্ধীকে তো সবাই চিনি। উনি ছাড়া দেশটির গুণী নেতা ও গুণী ব্যক্তিত্বদের তারা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আমাদের চার নেতার জীবনী জানলে কার ক্ষতি হবে? প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করলে কার ক্ষতি হবে? জাতীয় চার নেতার জেলহত্যা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করলে কার ক্ষতি হবে?