বিদ্যুৎ-গ্যাসে সংকট কাটেনি

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


পর্যাপ্ত জ্বালানি পণ্যের অভাবে নানামুখী সংকট বাড়ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, উৎপাদন, সঞ্চালন ও পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে গত এক যুগে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দূর হয়নি। নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদনে মনোযোগ না দেওয়ায় এখন বাড়তি দামে জ্বালানি পণ্য কিনতে হচ্ছে। ডলার সংকটে জ্বালানি পণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যবস্থা। গ্যাস এবং বিদ্যুতের অভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে।

২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো হয়। কিন্তু তা আবার অনেক কমে গেছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়া নিজেদের অন্য কোনো খনির কয়লা ব্যবহারের সিদ্ধান্তই এখনো নিতে পারেনি সরকার। এমনকি ভোলার বিপুল গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার কোনো উদ্যোগ আগে থেকে নেয়নি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হচ্ছে।

শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, শিল্পের জন্য সরবরাহকৃত গ্যাসও আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। নিজস্ব উৎপাদিত গ্যাসের সঙ্গে আমদানিনির্ভর এলএনজি সরবরাহ করতে না পারলে শিল্পে গ্যাসের চাপ থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারের অনেক নীতিনির্ধারক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ফলে বেশি দাম দিয়ে গ্যাস বা তেল আমদানি করে দেশের স্বাভাবিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গত এক যুগে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে শতাধিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। আরও অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। মাত্র চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থেকে প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। সারাদেশের মানুষকে বিদ্যুতায়নের আওতায় এনেছে। কিন্তু এখন এসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছে, ডলার সংকট এবং জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কবে নাগাদ সংকট কাটবে তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, শীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। শীতে স্বাভাবিক হওয়ার অন্যতম প্রধান যুক্তি হলো তখন মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সংকট হয়েছে ঠিকই; তবে সরকারের ভুলনীতিও আছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি, এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারে দেশ। নিজস্ব জ্বালানির উৎসের অনুসন্ধান না করে কেবল আমদানিনির্ভরতা অবশ্যই বিপদ ডেকে আনবে। এখন সেটাই হয়েছে।’ পরিকল্পনাহীন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ভুলনীতি এবং দুর্নীতি এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

এদিকে জ্বালানি সংকট নিয়ে উদ্বেগের কারণে দফায় দফায় বৈঠক করছেন ব্যবসায়ী ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা। গত সপ্তাহে জ্বালানি সংকট সমাধানে রাজধানীর এক হোটেলে ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সেমিনার আয়োজন করে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। সেমিনারে ব্যবসায়ীরা গ্যাস সংকট দ্রুত সমাধানে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি, সিএনজি, আবাসিক ও সার কারখানা থেকে গ্যাস শিল্পে সরবরাহের বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ায় উপদেষ্টা বলেন, ‘স্পট মার্কেট থেকে ছয় মাস এলএনজি কিনলে ব্যয় করতে হবে ১২০ কোটি ডলার। দেশে রিজার্ভের যে অবস্থা, এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করার মতো রিস্ক সরকার নেবে না।’

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা জানি না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কত দিন চলবে? সামনে কী হবে? ভবিষ্যতে এলএনজির দাম কেমন হবে? ফলে এই মুহূর্তে প্রতিমাসে স্পট মার্কেট থেকে ২০০ এমএমসিএফডি এলএনজি কিনতে ২০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে। ছয় মাস এলএনজি কিনলে ব্যয় করতে হবে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ফলে আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, সে জন্য আমরা এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করার মতো রিস্ক নিতে পারব না।’

তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে সেটা শিল্প খাতে সরবরাহ করার কথা ভাবা যেতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে গত বুধবার মতবিনিময়সভা করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। সেখানেও ব্যবসায়ীরা তাদের শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কথা তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রয়োজনে দাম বাড়িয়ে হলেও গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানান।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ব্যবসায়ীদের সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্পের প্রসারে কাজ করা হবে। তিনি বলেন, পরিকল্পিত এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন করলে এককভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে সুবিধা পাওয়া যেত। তবে বিচ্ছিন্নভাবে যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপন করায় এ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত জুলাইয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দিনে এক ঘণ্টা ‘শিডিউল’ লোডশেডিংয়ের কথা বলা হয়। কিন্তু সেই লোডশেডিং এক ঘণ্টায় থেমে থাকেনি। দিনে ছয়-সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে নসরুল হামিদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এখন যে সংকট চলছে, সেটা বাংলাদেশের একার নয়। বিশ্বব্যাপী এ সংকট চলছে। এলএনজির দাম এত বেড়ে গেছে যে আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে সরকার সংকট সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।’

দেশে শিল্পকারখানার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা । বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজনের দ্বিগুণ হলেও গ্যাস ও তেল সংকটে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে দেশের লোডশেডিং অব্যাহত আছে। এদিকে গ্যাসের সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন কমে যাচ্ছে। দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২৬শ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগওয়াট। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *