ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে এবং পানিতে ডুবে দেশের ১৩ জেলায় অন্তত ৩০ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
ভারি বর্ষণ আর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সাগরে থাকা ড্রেজার ডুবে নিখোঁজ হওয়া আট শ্রমিকই নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে তাদের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা। গতকাল সোমবার রাত ১০টার দিকে তারা নিখোঁজ হন।
নিহতরা হলেন শাহীন মোল্লা (৩৮), ইমাম মোল্লা (৩২), মাহমুদ মোল্লা (৩২), আলামিন (২১), তারেক, আবুল বশর (৪৫)। অপর দুজনের নাম জানা যায়নি। নিহত সবার বাড়ি পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি মোল্লাবাড়ি থানায়।
সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়।
এর মধ্যে ভোলা সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশনে মারা গেছেন চারজন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঝড়ো বাতাসে ঘরের ওপর গাছ পড়ে প্রাণ গেছে এক দম্পতি এবং তাদের চার বছরের শিশুর।
এছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন করে; নড়াইলের লোহাগড়া, বরগুনা সদর, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এবং শরীয়তপুরের জাজিরায় একজন করে মারা গেছেন ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে।
সিরাজগঞ্জের সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।পটুয়াখালীতে ট্রলার ডুবে মারা গেছেন এক শ্রমিক।
ঝড়ের সময় ঢাকার হাজারীবাগেও দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যুর খবর দিয়েছে পুলিশ। আর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জোয়ারের পানিতে ভেসে এসেছে এক শিশুর লাশ, যে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর–
সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ২২ মৃত্যু
ভোলায় ৪ মৃত্যু
ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে ভোলার দৌলতখান, চরফ্যাশন ও সদর উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া লালমোহনে জোয়ারের পানিতে ডুবে এক নারীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
দৌলতখান উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম জানান, ঝড়ের মধ্যে পৌর শহরে একজন নিহত ও তিনজন আহত হন। নিহত নারীর নাম বিবি খাদিজা (৮০) বলে জানা গেছে। তিনি দৌলতখান পৌরসভায় মৃত গোলাম মোস্তফার স্ত্রী।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘরের ওপর গাছ পড়লে ওই বৃদ্ধা নিচে চাপা পড়েন। আত্মীয়-স্বজনরা উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
চরফ্যাশনের ইউএনও আল নোমান বলেন, সেখানে আলম স্বর্ণকার নামে এক ব্যক্তি ভেঙে পড়া গাছের ডালের সঙ্গে আঘাত পেয়ে নিহত হয়েছেন। তিনি উপজেলার এওয়াজপুর এলাকার বাসিন্দা।
পরিবারের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, তিনজন মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। পথে ঝড়ে একটি গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল। চালক ডালের নিচ দিয়ে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও আলম ডালে আঘাত পান। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া ভোলা সদরের ধনিয়া এলাকায় গাছ চাপা পড়ে মফিজল হক নামে ৬২ বছরের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয় বলে সদরের ইউএনও তৌহিদুর ইসলাম জানিয়েছেন।
এদিকে লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতেমাবাদ গ্রামে জোয়ারের পানিতে ডুবে রাবেয়া বেগম নামে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণীর মৃত্যু হয়।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেম জানান, রাত সাড়ে ৩টার দিকে জোয়ারের পানি বেড়ে রাবেয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে অন্য ঘরে যাওয়ার সময় তিনি পানিতে ডুবে যান।
লালমোহন থানার ওসি মো. মাহবুবুর রহমান জানান, রায়ের লাশ মর্গে পাঠাতে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।
কুমিল্লায় তিন মৃত্যু
ঝড়ের মধ্যে রাত ১১টার দিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়নের হেসাখাল পশ্চিম পাড়ায় গাছ ভেঙে ঘরের উপর পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- হেসাখাল পশ্চিম পাড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী এবং তাদের মেয়ে চার বছরের শিশু নুসরাত আক্তার লিজা।
হেসাখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল বাহার বলেন, “ঝড়ো বাতাসে বড় একটি গাছ উপড়ে তাদের ঘরের ওপর পড়ে। পরে ভেতর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।”
নাঙ্গলকোট থানার ওসিফারুক হোসেন বলেন, ঘরের ওপর পড়া গাছটি সরানোর চেষ্টা করছেন তারা। ওই তিনজন ছাড়া আরও কেউ চাপা পড়েছে কি-না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে মা ও ছেলের মৃত্যু
ঝড়ের সময় সিরাজগঞ্জ সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহন ও শিল্পপার্কের মাঝামাঝি এলাকার খালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বৈঠাচালিত নৌকাটি শিল্পপার্ক থেকে পূর্বমোহনপুরে যাচ্ছিল।
মৃত দুজন হলেন– উপজেলার পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) এবং তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ওই নৌকায় চড়ে মোট ছয়জন পূর্বমোহনপুরে তাদের বাড়িতে ফিরছিলেন। মাঝপথে ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে নৌকাটি ডুবে যায়।
“আরাফাত মায়ের কোলে ছিল, সে নদীতে ডুবে মারা যায়। স্থানীয়রা আয়েশা খাতুনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। তবে নৌকায় থাকা অন্যরা সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হনে।”
পটুয়াখালীতে ট্রলার ডুবে শ্রমিকের মৃত্যু
পটুয়াখালীতে ঝড়ের মধ্যে নোঙ্গর করা ইটভর্তি একটি ট্রলার ডুবে নিখোঁজ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
নিহত নূর ইসলাম (৪০) সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরপুর গ্রামের রশিদ মোল্লার ছেলে।
সোমবার রাত ৮টার দিকে প্রতাপপুর লঞ্চঘাটে নোঙ্গর করা অবস্থায় ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারটি লোহালিয়া নদীতে ডুবে যায়। ট্রলারের মালিক জলিল মোল্লা সাঁতরে তীরে ফিরতে সক্ষম হলেও নূর ইসলাম ডুবে যান।
ঝড় কেটে যাওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে তিন ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে ডুবুরিরা ডুবে যাওয়া ওই ট্রলার থেকে নূরের লাশ উদ্ধার করে বলে জানান পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের টিম লিডার মো. মজিবর রহমান।
পটুয়াখালীর একটি ইট ভাটা থেকে ২৫ হাজার ইট নিয়ে মুরাদিয়া যাচ্ছিলেন ট্রালার মালিক জলিল মোল্লা। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তিনি লঞ্চঘাটে ট্রলার নোঙ্গর করেছিলেন।
সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ২২ মৃত্যু
গোপালগঞ্জে গাছ চাপায় দুই নারীর মৃত্যু
রাতে ঝড়ের মধ্যে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচ কাহনীয়া ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামে গাছ চাপা পড়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে।
তারা হলেন–পাঁচ কাহনীয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) এবং বাঁশবাড়িয়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রুমিছা বেগম (৬৫)।
টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, ঝড়ের সময় শারমিন বেগম ঘরের বারান্দায় বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একটি গাছ ভেঙে ঘরের বারান্দায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
আর রুমিছা বেগমের বাড়িতে যখন গাছ ভেঙে ঘরে পড়ে, তিনি তখন ঘরে শুয়ে ছিলেন। তিনিও ঘটনাস্থলে মারা যান বলে জানান ওসি।
নড়াইলে নারীর মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় উপকূলে পৌঁছানোর আগেই দুপুরে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ ঘটনা ঘটে বলে লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দীন জানান।
নিহত মর্জিনা বেগম (৪০) বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামের বাসিন্দা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১১ বছরের ছেলেকে নিয়ে তিনি লোহাগড়া পৌর এলাকার রাজপুর গ্রামের আবদুল গফ্ফারের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বিভিন্ন বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন তিনি।
দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা পরিষদ চত্বর দিয়ে যাওয়ার সময় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সামনে পৌঁছালে একটি মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথায় পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। লোকজন তাকে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নাদিরা ভূঁইয়া বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় আঘাত ছিল।
লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
বরগুনায় শতবর্ষী বৃদ্ধার মৃত্যু
বরগুনা সদর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে গাছের নিচে চাপা পড়ে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার প্রাণ গেছে।
সোমবার রাত সাড় ৮টার দিকে উপজেলার ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সোনাখালী বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাওসার হোসেন জানান।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মাইন উদ্দীন ময়না জানান, ওই নারীর নাম আমেনা খাতুন। সন্ধ্যার আগেই তার পরিবারের সদস্যদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা রাজি হননি। এমনকি আমেনা খাতুন তার স্বজনদের ঘরেও যাননি।
“উনি ছোট্ট একটি ঘরে একা থাকতেন। ঘরের পাশে থাকা চাম্বল গাছ উপড়ে পড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে স্বজনরা গাছ সরিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করে।”
ইউএনও কাওসার হোসেন বলেন, “আমরা আমেনা খাতুনের বাড়ি গিয়ে বিস্তারিত জেনেছি। তার দাফনসহ সার্বিক সহযোগিতা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।”
ঢাকায় রিকশাচালকের মৃত্যু
সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে ঢাকার হাজারীবাগে দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় জিগাতলার মনেশ্বর রোডে এ ঘটনায় আহত হয়েছেন এক মোটর সাইকেল চালক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, স্থানীয় লোকজন দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এলে রিকশাচালককে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওই ব্যক্তির নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
আহত মোটর সাইকেল চালককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
হাজারীবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এনামুল হক খন্দকার বলেন, “ঘটনার সময় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। নিহত ব্যক্তি রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বাইক আরোহী। তখন চারতলা একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে পড়ে।”