চীন থেকে ডেমু ট্রেন কিনতে খরচ করা হয়েছিল ৬০০ কোটি টাকা। এরপর যে কদিন চলেছে, পরিচালনার ব্যয়ই তোলা যায়নি। সাত বছরের মাথায় ডেমুগুলো অচল হয়ে যায়। এখন সেই ডেমু ট্রেনই আবার মেরামতের প্রকল্প নিতে তোড়জোড় শুরু করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে অর্থ ব্যয়ে এই ট্রেন মেরামত করে কত দিন চলবে, ডেমু চালিয়ে ব্যয় উঠবে কি না—এসব বিষয়ে এখনো সন্দিহান রেলের নীতিনির্ধারকদের অনেকে।
এই পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে রেলওয়ের পক্ষ থেকে ডেমু ট্রেনের মেরামতের বিষয়ে একটি ‘পাওয়ার পয়েন্ট’ উপস্থাপনা দেখানো হবে। সূত্র জানিয়েছে, উপস্থাপনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনায় আগামী বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সব ডেমু মেরামতের লক্ষ্যের কথা বলা হবে।
চীন থেকে ২০ সেট ডেমু কেনা হয় ২০১৩ সালে। সাত বছর চালানোর পর সেগুলো অচল হয়ে যায়। সম্প্রতি রেলওয়ের যন্ত্রকৌশল (মেকানিক্যাল) বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানকে দিয়ে পার্বতীপুর ওয়ার্কশপে এক সেট ডেমু ট্রেন মেরামত করা হয়। গত ৯ অক্টোবর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম ট্রেনটির পরীক্ষামূলক চলাচল উদ্বোধন করেন।
রেলমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, যে ডেমুটি সচল করা হয়েছে, সেটি যাত্রী নিয়ে দুই মাস চলার পর বোঝা যাবে, মেরামত কতটা টেকসই। আজ বৈঠকে বাকিগুলোর মেরামতে ব্যয়, প্রযুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের ডেমু ট্রেনে উচ্চ প্রযুক্তির সফটওয়্যারনির্ভর মডিউল ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। মেরামতকালে প্রায় দেড় বছর ধরে এক সেট ডেমুর যাবতীয় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা ও যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন যে যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তা সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য।
রেলওয়ের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, সাশ্রয়ী বলা হলেও একটি ডেমু ট্রেন মেরামতে কত টাকা খরচ হয়েছে, এর কোনো হিসাব এখনো জানা যায়নি। মডিউল পরিবর্তন ও কারিগরি কাজে প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য আরও ব্যয় আছে। সব মিলিয়ে প্রতিটি ডেমু মেরামতে কোটি টাকার ওপর খরচ হতে পারে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, আজ রেলসচিবের সভাপতিত্বে আয়োজিত বৈঠকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বাকি ডেমু ট্রেনগুলোও মেরামতের সিদ্ধান্ত নেওয়া। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারও কারও আশঙ্কা, মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে শেষ পর্যন্ত ব্যয় আরও বেশি হতে পারে। কারণ, এই মেরামতব্যবস্থায় উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে না।
১৫ মাসে সব ডেমু মেরামতের পরিকল্পনা
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বৈঠকের জন্য যে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে বর্তমানে ছয় সেট ডেমু সচল আছে। এর মধ্যে ঢাকায় দুই সেট ডেমু সচল। কিন্তু কমলাপুর স্টেশন বা ঢাকা বিভাগের কোথাও গত এক মাসের মধ্যে কোনো ডেমু ট্রেন চলেনি বলে নিশ্চিত করেছে রেলের পরিচালন বিভাগ। লালমনিরহাট বিভাগে একটি ট্রেন সচল, সেটিই মেরামতের পর মন্ত্রী উদ্বোধন করেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে তিন সেট ডেমু সচল থাকার তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে রেলের চট্টগ্রাম বিভাগের সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট পথে চালাতে গিয়ে গত মাসে একটি ডেমু ট্রেন মাঝপথে অচল হয়ে পড়ে। এভাবে প্রায়ই মাঝপথে অচল হয় বলে এসব ট্রেন চালাতে চায় না পরিচালন বিভাগ।
এ ছাড়া ছয় সেট ডেমু সচল থাকার কথা বলা হলেও নতুন করে সব কটি মেরামতের প্রস্তাব নিয়েই আজকের বৈঠক ডাকা হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাও দেওয়া হয়েছে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায়।
পরিকল্পনা অনুসারে, মডিউল পরিবর্তনসহ কম মেরামতে চালু করা সম্ভব এমন দু–তিন সেট ডেমু ট্রেন আগামী জানুয়ারির মধ্যে সচল করা হবে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় আরও পাঁচ সেট ডেমু ট্রেন আগামী জুনের মধ্যে মেরামত করা সম্ভব বলে জানানো হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি সব ডেমু ট্রেন মেরামত করা হবে।
রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ছয় সেট ডেমু সচল থাকলে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে না কেন? আর সচল ট্রেন কেন টাকা খরচ করে মেরামত করা হবে? আসলে এর আগেও ডেমু ট্রেন সচল করার কথা বলে সাড়ে ১০ কোটির মতো টাকা খরচ করা হয়েছে। এর বাইরে দৈনন্দিন মেরামতে আরও বিপুল টাকা খরচ হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এ পর্যন্ত ডেমু মেরামতে কত খরচ হয়েছে, পুনরায় মেরামতে কত খরচ হবে, সচল করার পর কত দিন চলবে—এটা নিশ্চিত না হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ডেমু এখন গলার কাঁটা। ৬০০ কোটি টাকার ট্রেন ফেলা যাচ্ছে না। আবার মেরামত করে যে চলবে—এরও নিশ্চয়তা নেই।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যে ডেমুটি সচল করা হয়েছে, সেটি যাত্রী নিয়ে দুই মাস চলার পর বোঝা যাবে মেরামত কতটা টেকসই।
আজ বৈঠকে বাকিগুলোর মেরামতে ব্যয়, প্রযুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি জানান, মূল ডেমুতে ২০টা ব্যাটারি লাগতো। এখন দুটি ব্যাটারি দিয়ে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে মেরামত সম্ভব হলে পরবর্তী টুকটাক মেরামত দরকার হলে সমস্যা হবে না।
ডেমু কেনাতেই গলদ
২০ সেট ডেমু কেনা হয় ২০১৩ সালে, ব্যয় হয় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ডেমু ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে প্রায় ৯৭ লাখ। আয় হয়েছে ২২ কোটি টাকার মতো। মেরামত ও জ্বালানির পেছনে আবার খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
রেলের প্রতিটি ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগনের অর্থনৈতিক বয়সসীমা (ইকোনমিক লাইফ) ধরা আছে। ইঞ্জিনের বয়সসীমা ২০ বছর। কোচ ও ওয়াগনের বয়সসীমা যথাক্রমে ৩৫ ও ৪৫ বছর। একেকটি ডেমু তিন থেকে সাত বছর টিকেছে।
চুক্তি অনুসারে, ডেমু ট্রেন সরবরাহ ছাড়াও ১৯ ধরনের প্রধান যন্ত্রাংশ, ৩৭ ধরনের সাধারণ যন্ত্রাংশ, ১৩৭ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ যন্ত্রাংশ এবং ৩৭ ধরনের (সরঞ্জাম) টুলস ও মেরামতকাজে ব্যবহৃত যন্ত্র দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রকল্প কর্মকর্তারা এসব যন্ত্রের সব কটি ঠিকভাবে বুঝে নেননি বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়। এ জন্য পরে ডেমু মেরামতের প্রয়োজনে যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়নি।
নথি থেকে জানা যায়, ডেমু কিনতে ৪৮ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করে আটজনকে চীন সফরে পাঠানো হয়েছিল, যাঁদের দায়িত্ব ছিল ডেমুর কার্যকারিতা ও অন্যান্য বিষয় দেখে আসা। ভ্রমণকারীদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগের ছয় কর্মকর্তা এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ও পরিকল্পনা কমিশনের একজন করে কর্মকর্তা ছিলেন। প্রকল্পের টাকায় ছয়জন প্রকৌশলীকে চার মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ জন্য ৯৭ লাখ টাকা খরচ হয়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, ডেমু সারা বিশ্বে চললেও বাংলাদেশের ট্রেনগুলোর মান ভালো নয়। নতুন প্রযুক্তি কেনার আগে অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি। নকশাও যাত্রীবান্ধব নয়। ফলে এই ট্রেন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, যাত্রীরাও সেভাবে গ্রহণ করেনি।
রেলওয়ে সরকারের মালিকানাধীন। এর লাভ-লোকসানের দায়ভার জনগণের। ডেমুর টাকা যে গচ্চা যাওয়ার পথে, সেটাও জনগণের টাকা। রেলওয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।